বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে শিল্পবিপ্লবের ফলে। বর্তমান বিশ্বও টিকে আছে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির ওপর। এখন পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে মোট তিনটি শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। এই শিল্পবিপ্লবগুলো বদলে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ, বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা। এখন প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বিপ্লবকেই বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। বাংলাদেশও রয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে।
যে কোনো জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো স্থানীয় সম্পদ শনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে এসব সম্পদের সঠিক সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের ১০টি দরিদ্রতম দেশের মধ্যে একটি, যেখানে ৭৫ শতাংশ মানুষ ছিল অক্ষরজ্ঞানহীন, গড় আয়ু ছিল ৪৫ বছর এবং অধিকাংশ মানুষ অপুষ্টি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিয়ে জীবন যাপন করছিল। স্থানীয় সম্পদ বলতে আমাদের ছিল শুধু কৃষিজ জমি ও জনশক্তি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দুটি সম্পদকে সফলভাবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং কৃষিতে উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর নিমিত্তে অতি দক্ষ কৃষিবিজ্ঞানী তৈরির লক্ষ্যে মেধাবীদের কৃষি শিক্ষায় আকৃষ্ট করেছিলেন। নিরক্ষর ও অদক্ষ কৃষিশ্রমিককে দক্ষ করার জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষির সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠান যেমন— বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি সমবায় সৃষ্টি এবং কৃষি শিক্ষা ইনস্টিটিউটগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে এগুলো শক্তিশালী করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম বাজেটে বঙ্গবন্ধু মোট বাজেটের প্রায় ৭ শতাংশের মধ্যে ১ শতাংশ কৃষি উন্নয়নে বরাদ্দ করেন এবং কৃষকদের মধ্যে অনেকাংশেই বিনা মূল্যে কীটনাশক, সার ও সেচ যন্ত্রপাতি ভর্তুকির মাধ্যমে বিতরণ নিশ্চিত করেন। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে কৃষকদের বিনা মূল্যে এসব কৃষি উপকরণ প্রদানের বিষয়টি বজায় থাকেনি। বরং কৃষি রসায়নশিল্প বিশেষ করে বালাইনাশক শিল্পটি ১৯৭৯ সালে সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেসরকারি খাতে প্রদান করা হয়। তখন বিধিবিধান ও নীতিমালাগুলো দেশীয় কৃষি রসায়ন শিল্প বিকাশে সহায়ক না হওয়ার কারণে কৃষি রসায়ন শিল্পটি প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর রয়ে গেছে। বালাইনাশক আইন, ২০১৮ এবং বিধিমালা, ২০২১-এ শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনের কোনো বিধান নেই। ফলে কোনো বিনিয়োগকারী এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে চাইলেও বিধিবিধানে কোনো আবেদনের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে কৃষি খাতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। যেমন— কৃষকেরা বিভিন্ন ফসলের প্রোডাকশন টেকনোলজির ব্যাপারে শিক্ষিত হয়েছে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক উচ্চফলনশীল ও সহনশীল বিভিন্ন জাতের উদ্ভাবন হয়েছে, বিএডিসির মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু কিছু কৃষি উপকরণ উত্পাদন ও বাজারজাতকরণ হচ্ছে, কৃষিবিজ্ঞানীরা সরকারের পলিসি মেকিংয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে এবং সর্বোপরি জিডিপিতে কৃষির অবদান শতকারা হারে ক্রমশ হ্রাস পেলেও সামগ্রিক অবদান অনেকাংশে বেড়েছে। কৃষিতে উন্নয়নের ধারা যেমন একদিকে চোখে পড়ার মতো, ঠিক তেমনি উন্নয়নের সুযোগও কম নয়। যেমন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশের কৃষকেরা দরিদ্র। দেশের শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক অংশ কৃষিতে কাজ করে এবং তারা মোট জিডিপির মধ্যে প্রায় ১১ শতাংশ সংযোজন করছে। বাকি অর্ধেক শ্রমশক্তি মোট জিডিপিতে প্রায় ৮৯ শতাংশ সংযোজন করে। শিল্পের বিভিন্ন খাত অনুযায়ী শ্রমশক্তির সঙ্গে জিডিপির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, শ্রমশক্তি ও জিডিপির মধ্যকার একটি অসামঞ্জস্যতা আছে, যা আমাদের দেশের অর্থনীতির একটি দুর্বলতা। কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষি, মৎস্য ও পশুপালনের সম্ভাব্য সব উপকরণ স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের কর্মসূচি গ্রহণ করলে আমাদের দেশে জিডিপি ও শ্রমশক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক সংগতিপূর্ণ হবে। তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আন্দোলনে কৃষিশিল্পকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করে সহায়ক নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করা, দক্ষ জনবল তৈরি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করতে হবে।
বিশেষ করে কৃষি সেক্টরে যেহেতু শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক অংশ কাজ করে, সেহেতু এই সেক্টরের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন করতে হবে। সে জন্য এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগেই আমাদের কৃষি, কৃষি রসায়ন শিল্প ও কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নের দিকে গুরুতরভাবে নজর দেওয়া দরকার। স্থানীয় কৃষি রসায়ন শিল্প বিকাশে বিভিন্ন নীতিমালা অনতিবিলম্বে সংশোধন ও সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। কৃষি খাতকে টেকসই ও লাভজনক করার জন্য বাংলাদেশে সম্ভাব্য সব কৃষি উপকরণ উত্পাদন করা আবশ্যক। কৃষি রসায়ন শিল্পের মধ্যে সার ও কীটনাশক আছে। আমরা অধিকাংশ সারই আমদানি করে থাকি। মিউরেট অব পটাশ ছাড়া আমরা প্রায় সব সার ও বালাইনাশক দেশে উত্পাদন করতে সক্ষম। আমরা বর্তমানে বালাইনাশকের ৯০ শতাংশের বেশি আমদানি করে থাকি। অথচ বালাইনাশক আমাদের দেশে উত্পাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। সে জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বালাইনাশক উৎপাদনে বালাইনাশকসহ কৃষিভিত্তিক সব শিল্পায়নে নীতিগত সহায়তা প্রদান প্রয়োজন।
বাংলাদেশ এলডিসি গ্রুপের সদস্য দেশ হিসেবে প্যাটেন্ট আইনের বহির্ভূত এবং বর্তমানে ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রির সব সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু কৃষি রসায়নশিল্পে নীতিগত সহায়তার অনুপলব্ধিতে স্থানীয় উত্পাদনকারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন টিআরআইপিএস সুবিধা থেকে। সবচেয়ে বড় বৈষম্য হলো, মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগেও আমরা বালাইনাশকের কাঁচামাল পৃথিবীর বিভিন্ন সোর্স থেকে আমদানি করতে পারি না। ফলে কাঁচামাল উচ্চমূল্যে ক্রয়ের কারণে স্থানীয়ভাবে উত্পাদন খরচ আমদানি মূল্য থেকে বেড়ে যাচ্ছে। তাতে করে উৎপাদনকারীর পরিবর্তে আমদানিকারকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। প্যাটেন্ট বৈষম্য, শুধু একটি দেশ বা কোম্পানি থেকে কাঁচামাল আমদানির ব্যাপারে অযৌক্তিক শর্তারোপ ও কাঁচামাল উৎপাদনের নীতিমালা না থাকাসহ অন্যান্য কারণে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উৎপাদনকারীদের ন্যায়সঙ্গত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিএএমএ নামে বাণিজ্য সংগঠন নিবন্ধনের লাইসেন্স প্রদান করেছে।
বর্ণীত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু নিম্নোক্ত ৯টি বিষয়ের দিকে নজর দিলেই এই শিল্প আমাদের আমদানির বিকল্প হয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিতে পরিণত হতে পারে : ১. এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগে বাংলাদেশের কৃষি রসায়নশিল্পকে সম্পূর্ণরূপে ‘প্যাটেন্ট সুরক্ষা আইন’ থেকে অব্যাহতি প্রদান; ২. বালাইনাশকের স্থানীয় উৎপাদনের জন্য উৎপাদনকারীদের ম্যানুফ্যাকচারিং লাইসেন্স দেওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির ন্যায় কাঁচামালের সোর্স উন্মুক্ত করা; ৩. আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাঁচামাল (টেকনিক্যাল) উৎপাদনের জন্য ম্যানুফ্যাকচারিং লাইসেন্স প্রদান করা; ৪. বিভিন্ন স্থান থেকে এনওসি নেওয়ার নিয়মের কারণে সময়ের যে জটিলতা সৃষ্টি হয়, তা দূর করা; ৫. স্থানীয় আমদানিকারকেরা যেন উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে বালাইনাশক কিনতে পারেন, সে জন্য ইতিবাচক আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, ৬. স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বালাইনাশক রপ্তানির নিমিত্তে নিয়ম-নীতি ও বিধিমালা প্রণয়ন; ৭. বালাইনাশক নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়নসংক্রান্ত সব কমিটিতে বিএএমএ-র প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; ৮. একই পিটিএসি সদস্যরা পিটিএসিতে থাকার পাশাপাশি কেমিক্যাল টেস্টিং এবং ফিল্ড ট্রায়ালের সঙ্গে জড়িত। এতে করে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট দেখা যেতে পারে। উক্ত কমিটিতে ঔষধ শিল্পের ন্যায় ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটির (ডিসিসি) মতো করে সংস্কার করা; ৯. অত্যাবশ্যকীয় বালাইনাশকের একটি তালিকা তৈরি করা, যেগুলো যে কোনো ধরনের প্যাটেন্ট আইনের বহির্ভূত থাকবে।
কৃষি রসায়নশিল্প একটি টেকসই, নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং কৃষকদের জন্য লাভজনক এবং একটি আমদানি বিকল্প খাত হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম। অন্যান্য দেশ যেখানে তাদের ক্যাপাসিটি ও অবকাঠামো সরকারি সহায়তায় উন্নত করেছে, সেখানে বাংলাদেশে এই শিল্প এখনো উপেক্ষিত। সুতরাং, এটি সময়ের দাবি এবং আমরা বিশ্বাস করি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমদানি বিকল্প শিল্প গড়তে এবং সর্বোপরি কৃষি খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও টেকসই করতে, বাংলাদেশ সরকার ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সব কর্মকর্তা কোনো প্রকার কালবিলম্ব না করে যত দ্রুত সম্ভব শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে জরুরিভাবে বালাইনাশক বিধিমালা ২০২১ সংশোধনে হাত দেবেন।