আগামী নির্বাচনে দলের শক্তি ও সংহতি বাড়াতে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ ও ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী’ নেতাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর দলের জাতীয় কমিটির সভায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া দলীয় নেতাদের সাধারণ ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে আলোচিত কয়েক জন বহিষ্কৃত নেতা ক্ষমা পেয়ে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, কেউ আর ক্ষমার আওতার বাইরে থাকবেন না।
দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা বা অব্যাহতি পাওয়া নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনা আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কিছু নয়। দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা, আদর্শিক অবস্থান মজবুত রাখার স্বার্থে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে থাকলেও তা খুব একটা মেনে চলা হয় না। গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কমিটি থেকে যাদের বহিষ্কার কিংবা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এর প্রায় ৯৯ শতাংশ কিংবা তারও বেশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন।
শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আওয়ামী লীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কারের পর দলে ফিরিয়ে নেওয়ার অনেক নজির গত ১৪ বছরের শাসনামলে বহুবার স্থাপন করা হয়েছে। এবার ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে দলের জাতীয় সম্মেলনের আগে আগে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখেই বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের ক্ষমা করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ, যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই দলের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী নেতা ছিলেন। এত বিপুলসংখ্যক জনপ্রতিনিধি ও নেতাকে বাদ দিয়ে নির্বাচন কিংবা বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে।
ক্ষমা নিশ্চয়ই বড় গুণ। কিন্তু ক্ষমা পেয়ে কেউ যদি না শুধরায়?
এখানে বলে রাখা দরকার যে, মানুষ মাত্ররই কিন্তু ভুল হয়। আপনি যে-ই হোন না কেন, যত বড় পণ্ডিত কিংবা যতই নিরেট মূর্খ, মানুষের ভুল হয় এবং ভুল হতেই পারে। আমাদের দেশের মানুষের, বিশেষ করে দায়িত্ববান মানুষের যেন ভুলটা আরো বেশি বেশি হয়। কিন্তু এ দেশে কেউ ভুল স্বীকার করেন না। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা না, রাজনীতিবিদরা না, ব্যবসায়ীরা না, এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও না। তাহলে কি এ দেশে কেউ ভুল করেন না?
ভুল স্বীকার করাকে কখনোই নিরুত্সাহিত করা উচিত নয়। কেননা, ভুল স্বীকার করা একটি ইতিবাচক মানবিক ধর্ম। বৌদ্ধধর্মে তো ক্ষমাপ্রার্থনার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মেই এই ক্ষমাপ্রার্থনার বিশেষ গুরুত্ব আছে।
আসলে ভুল স্বীকার করতেই হবে। ভুল থেকেই ‘ঠিক’-এ যেতে হয়। যেমন অন্ধকার থেকে আমরা আলোর পথযাত্রী। ঠিক সেভাবেই অসত্য থেকে সত্যের পথে যাত্রা। ফরাসি দার্শনিক রাসেল এক বার মজা করে বলেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে ভ্রম হয় যে, আমরা একটা সত্য থেকে আর একটা সত্যে যাচ্ছি, নাকি একটা অসত্য থেকে আর একটা অসত্যের পথে যাচ্ছি। কারণ, আজ যেটাকে সত্য বলে আঁকড়ে ধরছি, সেটা কাল হয়ে যায় হাইপোথিসিস। আসলে, আমরা একটা হাইপোথিসিস থেকে আর একটা হাইপোথিসিসেই হাঁটছি!’
সেদিক থেকে ‘ভুল’ ও ‘ক্ষমা’ও একটা হাইপোথিসিস!
প্রসঙ্গত, চীনে একটি কোম্পানি ছিল, হয়তো এখনো আছে। বেশ কয়েক বছর আগে তার কথা লিখেছিলেন এক মার্কিন সাংবাদিক। কোম্পানিটির কাজ ক্ষমা চাওয়া। অন্যের হয়ে ক্ষমা চাওয়া। তাদের স্লোগানই হলো :আমরা আপনার হয়ে ‘সরি’ বলব। ব্যাপারটা কী? আসলে ও দেশের মানুষ চট করে ক্ষমা চাইতে পারেন না। সাহেবরা যেমন কথায় কথায় ‘হা-ই, সরি অ্যাবাউট দ্যাট’ বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সব দুঃখটুঃখ ঝেড়ে ফেলে নিজের কাজে চলে যেতে পারেন, চীনে অনেকেরই এখনো সেটা রপ্ত হয়নি। এ ব্যাপারে বাঙালি-চীনা ভাই ভাই বলা যায়, আমাদের এ দিকেও অনেকেই এখনো সাহেবি কেতাবে তেমন অভ্যস্ত হননি, পথেঘাটে, বাজারে মার্কেটে কিংবা ট্রেনে-বাসে কারো পা মাড়িয়ে দিয়ে ‘সরি’ বললে নিস্তার মেলে না, উলটো মুখঝামটা খেতে হয়, ‘ঐ এক বুলি শিখিয়ে দিয়ে গেছেন ইংরেজরা, বললেই অমনি সাত খুন মাপ হয়ে গেল!’
তবে ভাইয়ে ভাইয়ে সবকিছু তো আর মেলে না, একটা ব্যাপারে চীনের লোকেরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ওস্তাদ। ওরা ব্যবসাটা ফাটাফাটি বোঝে। ক্ষমা চাইতে লজ্জা, ‘সরি’ বলতে অস্বস্তি—এই স্বভাবটাকেই দিব্যি পুঁজি বানিয়ে কেউ কেউ লক্ষ্মীর সাধনায় নেমে পড়েছে। যেমন, ঐ কোম্পানিটি। ওরা ক্রেতাদের নানা রকম প্যাকেজ বিক্রি করে। ক্ষমা চাওয়ার প্যাকেজ। ধরা যাক, দুই বন্ধুর বেধড়ক ঝগড়া হয়েছে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তারপর একদিন, যেমন হয়, এক বন্ধুর মনটা হুহু করে উঠল। হয়তো অন্যেরও। কিন্তু বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না, বরফও গলে না। এসব বিপদে তৃতীয় বন্ধুর একটা ভূমিকা থাকে; কিন্তু সমাজ পালটেছে, ভালো বন্ধুর সংখ্যা কমেছে, তেমন বৃন্দা দূতী মেলা কঠিন। এখানেই মুশকিল আসান কোম্পানির প্রবেশ। ওদের সাফ কথা :ক্ষমা চাইতে চান, কিন্তু লজ্জা পাচ্ছেন? চলে আসুন, আমাদের কাছে, বলুন আপনার কেস হিস্ট্রি, জানিয়ে দিন কতটা জোর দিয়ে সরি বলতে চান। আমরা আপনার চাহিদা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা করে দেব। আমাদের লোক চিঠি লিখবে, ফোন করবে বা সশরীর চলে যাবে আপনার অভীষ্ট মানুষটির কাছে, যথাযথ ভাষায় ও ভঙ্গিতে ক্ষমা চেয়ে আসবে তার কাছে। শুকনো সরির সঙ্গে যদি কিছু উপহার দিতে চান, তার ব্যবস্থাও আমরাই করে দেব। দাম প্যাকেজ অনুসারে।
এ কোনো শখের কারবার নয়। ঐ কোম্পানিতে যারা কাজ করেন, মানে ক্ষমা চেয়ে বেড়ান, তারা রীতিমতো শিক্ষিত, সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে আছেন শিক্ষক, আইনজীবী, সমাজকর্মী। তারা স্বভাবে শান্ত, মগজে বিচক্ষণ, চমৎকার কথা বলেন। তার ওপর তাদের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়। ক্ষমা চাইবার ট্রেনিং, যাতে তারা আরো দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। একটা ব্যাপার খেয়াল করা ভালো। এই কাজে দক্ষতার মূল্যায়ন বেশ সহজ। ক্ষমা চাইবার ফলে মনোমালিন্য মিটল কি না, দূরত্ব কতটা কমল, সেটাই বলে দেবে, পেশাদার ক্ষমাপ্রার্থী তার পেশায় কতটা সফল।
মার্কিন সাংবাদিকটির লেখার সূত্র ধরে চীনের এই কোম্পানিটির কথা জানিয়েছেন মাইকেল স্যান্ডেল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রবীণ অধ্যাপক ন্যায়, নীতি, নৈতিকতা নিয়ে অসামান্য সব লেখা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। ‘জাস্টিস’ নামে তার বক্তৃতামালা আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ববিশ্রুত। বছর কয়েক আগে প্রকাশিত তার লেখা ‘হোয়াট মানি কান্ট বাই’ নামক একটি স্বল্পকায় বইয়ে তিনি আলোচনা করেছেন, আমাদের জীবনের সমস্ত অন্ধিসন্ধিতে বাজার কীভাবে অনুপ্রবেশ করেছে, এমন অনেক কিছুর দখল নিয়েছে, যা আমরা আগে বাজারের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না। ক্ষমা চাওয়ার চীনা বাজার নিয়ে আলোচনা এসেছে সেই সূত্রেই। খেয়াল করা দরকার, এই বাজার পশ্চিম দুনিয়ায় হয়নি। হবে না, কারণ সেখানে মানুষ অনায়াসে এবং অবলীলাক্রমে ক্ষমা চায়। চীনের মতো দেশে ক্ষমা চাওয়া মানে মুখের কথা নয়, সত্যিই মাথা হেট করা। ‘সরি’ বলাটাকে লোকে সিরিয়াসলি নেয় বলেই সহজে বলতে পারে না, পারে না বলেই এই নিয়ে দিব্যি একটা ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এটা আপাতদৃষ্টিতে একটা প্যারাডক্স বলে মনে হতে পারে; কিন্তু আসলে এখানেই বাজারের ক্ষমতা। যা-কিছু আমাদের কাছে মূল্যবান, বাজার তাকেই আত্মসাৎ করে, সেই মূল্যকে মুনাফায় রূপান্তরিত করে ফেলে! সে পেশাদার প্রতিনিধিকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানোই হোক, হিরের আংটি কিনে ভালোবাসা জানানোই হোক। তাতে শেষ পর্যন্ত মানবিক অনুভূতিগুলোর মূল্য কমে যাবে কি না, মূল্য কমে গেলে বাজারটাই উধাও হবে কি না, সে-সব ভবিষ্যতের ব্যাপার। ভবিষ্যতে আমরা সবাই মৃত।
আমাদের দেশেও ক্ষমা চাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। বিশেষ করে রাজনীতির লোকেরা চট করে ‘সরি’ বলতে রাজি নন। অথচ প্রতিপক্ষ কেবলই তাদের পুরোনো পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে বলে, তাই নিয়ে শোরগোল তোলে। কোনো পক্ষই ক্ষমা চাইবে না, ওদিকে প্রতিপক্ষও ছাড়বে না। তাই ভাবছিলাম, চীনের মতো একটা কোম্পানি তৈরি করলে হয় না? আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, কাদের সিদ্দিকী, ড. কামাল হোসেন—যেই হোক, যে কারণেই হোক, যখন যেখানে দরকার, যার কাছে দরকার, ক্ষমা চেয়ে আসবে। খরচটা দিয়ে দিলেই হলো, ব্যস!