বাংলাদেশে গত বছর থেকে যে ডলার-সংকট শুরু হয়েছিল, নতুন বছরেও সে সংকট কাটেনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের অভাবে তারা ব্যাংকে এলসি খুলতে পারছেন না। আমদানি মূল্য মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। যদিও এর আগে একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নতুন বছরে ডলার-সংকট কাটতে শুরু করবে। কিন্তু সংকটের কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না।
শুধু বিলাসী পণ্যই নয়, প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসিও খোলা যাচ্ছে না। শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের আমদানি আটকে আছে।
এদিকে, ডলার-সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে ছোট ও মাঝারি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা ব্যাপক হারে কমেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতাও কমে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমদানির জন্য শতভাগ টাকা দেওয়া হলেও ব্যাংক ডলার দিতে পারছে না। ডলার-সংকট মোকাবিলায় অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুত্সাহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। অথচ বিলাসী নয়, এমন পণ্যেও শতভাগ মার্জিন রাখা হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে খোলাবাজার থেকে কাঁচামাল চড়া দামে সংগ্রহ করে কারখানা চালু রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যারা ডলারে আয় করে না, তারাও এখন এলসি খুলতে পারছেন না। এর মধ্যে দেশীয় চাহিদা পূরণে যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদন করে তারাও এলসি খুলতে পারছে না।
আগামী রমজান মাসকে সামনে রেখে সাতটি পণ্য জরুরি ভিত্তিতে আমদানিতে সহায়তা করার জন্য ডিসেম্বর মাসের শুরুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব পণ্য আমদানিতে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছিল। এসব পণ্য আমদানিতে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার দরকার হবে। সে সময় ব্যবসায়ীদের এলসি সমস্যা মেটাতে একটা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল খোলার কথাও জানিয়েছিল সরকার। কিন্তু ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে এসেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির এখনো খুব একটা উন্নতি হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সব সেক্টরই ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছে। তুলনামূলক তৈরি পোশাক শিল্প কিছুটা ভালো রয়েছে। কারণ তারা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে পারছে। কিন্তু অন্যান্য সেক্টরের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে তারা সমস্যায় পড়ছেন। অনেকেই চাহিদার চেয়ে কম কাঁচামাল এলসির মাধ্যমে আনতে পারছেন। ফলে উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে যারা আমদানির ওপর নির্ভর করে দেশে পণ্য সরবরাহ করেন তারা সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশে ডলারের সংকট ও বৈশ্বিক বাণিজ্যিক অস্থিরতার কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল, ইন্টারমিডিয়েট গুডস (শিল্পের জন্য মধ্যবর্তী পণ্য বা কাঁচামাল) ও কনজ্যুমার গুডস তথা ভোগ্যপণ্য আমদানির ব্যাপক পতন হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি দাঁড়ায় ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছিল ৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের। একই সঙ্গে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে যথাক্রমে ৪.১২ ও ১.২০ বিলিয়ন ডলার। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে ছিল ৪.৬৯ ও ১.৬৫ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। বিদেশি বায়ারদের দেশ থেকে পোশাক আমদানির চাহিদা কমে গেছে। একই সঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট থাকায় ব্যবসায়ীরা চাহিদা থাকলেও আমদানি করতে পারছে না। যার কারণে সব ধরনের আমদানির পরিমাণ কমেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরের মধ্যে ইন্টারমিডিয়েট গুডস বা মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি হয়েছে ২ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের এ সময়ে ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানি কমেছে ৩৩.১৮ শতাংশ।
একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার পরিমাণ খুবই কম। কারণ তারা এ সময়ে এলসি খোলার চেয়ে ডলার সংগ্রহে বেশি নজর দিচ্ছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। আগে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা যেত, এখন প্রায় ১২০ টাকা লাগছে। যার কারণে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির পরিমাণ কম।
গত ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, আমাদের অপ্রয়োজনীয় অনেক এলসি হয়েছে। এছাড়া আমদানির মাধ্যমে অনেক ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে। এখন আমরা সব আমদানিতে খুব নজরদারি করছি, এতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং অনেকটাই কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে রেমিট্যান্স বাড়িয়ে এবং আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করেই ডলার-সংকট দূর করা হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ কোনো সমাধান নয়। এটা চলতে থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি জানিয়েছেন, ডলার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরো কিছু দিন সময় লাগবে।
রেমিট্যান্স কম আসার কারণে বাধ্য হয়েই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২২ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার পরও ডলার-সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
আমদানির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেপার ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও এফবিসিসিআই পরিচালক শাফিকুল ইসলাম ভরসা বলেন, ডলার সংকটের কারণে শতভাগ এলসি মার্জিন দিয়েও কাগজ আমদানি করা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর কাছে বারবার ধরনা দিয়েও এলসি খুলতে পারছেন না তারা।