বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা) ঋণের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ৪২ মাসের চুক্তিতে ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি’তে সহায়তা হিসেবে বর্ধিত ঋণ সহায়তা (এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি—ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সহায়তার (এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি—ইএফএফ) আওতায় ৩৩০ কোটি ডলার এবং স্থিতিস্থাপকতা ও টেকসই সুবিধার (রেজিলিয়্যান্স অ্যান্ড সানসেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটি—আরএসএফ) অধীনে ১৪০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফের এক ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে আরএসএফ তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ।
বলে রাখা দরকার, বাংলাদেশ যখন আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করেছিল, তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে কমবেশি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই। এর কারণ, সরকার এমন এক সময়ে ঋণের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হয়, যখন অর্থনীতির ভগ্নদশার কারণে শ্রীলঙ্কায় চলছিল চরম অস্থিরতা এবং পাকিস্তানের অর্থনীতিও দুলছিল পেন্ডুলামের মতো!
এখন প্রশ্ন হলো, আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে? প্রথমত, এটা মনে রাখা জরুরি যে, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো আইএমএফের কাছে ‘বেলআউট (আর্থিক সংকটের সময়ে আর্থিক সহায়তা দানের মাধ্যমে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা কোনো দেশের অর্থনীতিকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা) প্যাকেজ চায়নি বাংলাদেশ। বরং বাংলাদেশ চেয়েছে ‘স্টেবিলাইজেশন প্যাকেজ’ তথা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার ঋণ। এ কথা অনেকের জানা, দেউলিয়া কিংবা দেউলিয়াত্বের মুখে পড়া দেশ বা সংস্থাকে আর্থিক সহায়তা প্রদানকে ‘বেলআউট’ নামে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে কাঠামোগত সংস্কারের জন্য ইএফএফ, বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যয় পরিশোধে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট—বিওপি) স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে আরএসএফ, স্থিতিশীলতা ও টেকসই অর্থনীতির স্বার্থে ইসিএফ প্যাকেজ প্রদান করা হয়। যেমনটা বলে থাকে আইএমএফ—‘এই ঋণ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও দুর্বল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সহায়তা করার জন্য প্রদান করা হয়।’ অর্থাৎ গুরুতর সংকটের জাঁতাকলে পড়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি টালমাটাল হওয়ার আগেই অর্থনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠার সুবিধার্থে ‘সতর্কতামূলক ব্যবস্থা’ হিসেবে আইএমএফের ঋণ সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
সাধারণত, যখন কোনো দেশ পেমেন্টের (বৈদেশিক বাণিজ্যের) ভারসাম্যের প্রশ্নে সংকটের সম্মুখীন হয় এবং সেক্ষেত্রে নীতি-নির্দেশনা নির্ধারণের প্রয়োজন পড়ে, সেই অবস্থায় ইসিএফ বা ইএফএফ ও আরএসএফের মাধ্যমে সাহায্য প্রদান করে আইএমএফ। সহজ কথায়, সংকটে পড়া দেশকে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি ঋণ-তহবিল প্রদান করে আইএমএফ, যা দীর্ঘ মেয়াদে পরিশোধ করার সুযোগ পায় ঋণগ্রহীতা দেশ। উদাহরণস্বরূপ, ইসিএফের ক্ষেত্রে শূন্য-সুদের হারসহ ঋণ পরিশোধে দীর্ঘ সময় পাওয়া যায়। ইসিএফ তহবিলের সাহায্যে একটি দেশ অর্থনৈতিক খাতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পারে খুব সহজেই। এই তহবিলের অর্থকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে ১০ বছর পর শূন্য সুদে ঋণ পরিশোধ করতে পারে দেশটি। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের জন্য পাওয়া যায় লম্বা সময়; তাও আবার বিনা সুদে। দীর্ঘ মেয়াদে বিনা সুদে পাওয়া ঋণ বিওপির ওপর জেঁকে বসা চাপকে প্রশমিত করতে অনবদ্য ভূমিকা রাখে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলে সমৃদ্ধ ও টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয় সরকার।
বাংলাদেশ ইসিএফের এই স্থিতিশীলতা-মূলক প্যাকেজ পাচ্ছে। যদিও এমন নয় যে, আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অভাব রয়েছে বাংলাদেশের। সাধারণত, তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহের সক্ষমতা ‘পর্যাপ্ত-নিরাপদ রিজার্ভ’ পজিশন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৩৩ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন (গ্রস) রিজার্ভ রয়েছে—যা দিয়ে অন্তত চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা অস্থির মনে হলেও একে ‘অপর্যাপ্ত’ হিসেবে অবিহিত করা যায় না কোনোভাবেই। এবং বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে এর অর্থ এই নয় যে, দেশ শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। বরং বাংলাদেশ ঋণ নিচ্ছে ‘প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা’ হিসেবে।
উল্লেখ করতে হয়, ঋণ পেতে হলে ঋণগ্রহীতা দেশকে আইএমএফের কিছু শর্ত বা সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হয়। বাংলাদেশও এই নীতির বাইরে নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কার আনার প্রস্তাব দেয়। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার ও নিষ্পত্তিসহ কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা আইএমএফের সংস্কারপ্রস্তাবগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ বেশ বেড়ে গেছে—এই পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত উক্ত সংস্কার-প্রস্তাব। আরেকটি বিষয়ে আইএমএফ থেকে পরামর্শ এসেছে—‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’-এর মতো পুরোনো আইনের পরিবর্তন—বলা বাহুল্য, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোসহ সরকারের বাজেট ঘাটতির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণও আইএমএফ-প্রদত্ত শর্ত।
বলা আবশ্যক, আগামী দিনগুলোতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়তি ও অপ্রয়োজনীয় ব্যায়ের লাগাম টানতে পারলে তা ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপকে সামাল দিতে কিছুটা হলেও কাজে আসবে। এছাড়া আরও কয়েকটি বিষয় বাংলাদেশকে মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, বাংলাদেশ যেহেতু আর স্বাধীনভাবে অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করতে পারবে না (আইএমএফের ঋণ হাতে পাওয়ার পর), তাই যখনই সরকার কোনো নীতি প্রণয়ন করবে, তখন অবশ্যই এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, তাতে যেন আইএমএফের কোনো শর্ত লঙ্ঘিত না হয়। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব মূল্যায়নের ভিত্তিতে কিছু আর্থিক নীতি প্রণয়ন করেছে। এর ফলে দেশে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পায় বটে, কিন্তু আইএমএফের সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতি রাখা গেছে। যদিও ২০০৯ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী অগ্রাধিকারমূলক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ধাক্কার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে কোনো না কোনো সময় নতুন নীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে অবধারিতভাবে। এখন দেখার বিষয়, কত দ্রুত দেশের অর্থনীতি কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা ছাড়াই টেকসই অবস্থানে দাঁড়াতে পারে। আইএমএফও চায় বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব বাড়াক। তবে ভুলে গেলে চলবে না, রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য যদি করের হার বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার, তবে তাতে দারিদ্র্যতা বাড়তে পারে। কাজেই বিদ্যমান ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত না করে কীভাবে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করা যায়, সে সম্পর্কে বিশদ চিন্তাভাবনা দরকার।
বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। যেখানে বিশ্বব্যাংকের আদর্শ অনুপাত ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ ভ্যাট ও কর রাজস্ব বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এর ফলে দরিদ্রদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই অবস্থায় আইএমএফ থেকে যে ঋণ-তহবিল পাওয়া যাবে তা দিয়ে দারিদ্র্য হ্রাসের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন সব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যাতে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতসহ জনসাধারণের ব্যয় বৃদ্ধির ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে।
এটাও ভালোভাবে আমলে নিতে হবে, আইএমএফ ঋণের অর্থ কয়েকটি কিস্তিতে সরবরাহ করবে। তার মানে, বাংলাদেশ যদি কঠোরভাবে শর্ত মেনে না চলে, তবেই অর্থ পাওয়া যাবে অব্যাহতভাবে—অন্যথায় বিপদ! অতীতে আমরা দেখেছি, পদ্মা সেতুর অর্থায়নে কথিত দুর্নীতি নিয়ে গুজবের কারণে প্রকল্প থেকে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্বব্যাংক। পর্যায়ক্রমে প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। অর্থাৎ কোনো ধরনের সন্দেহ দেখা দিলে আইএমএফও ঋণ স্থগিত করে দিতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি খাবে জোর ধাক্কা। কারণ অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনাও তখন ‘শূন্য’ হয়ে পড়বে—যেমনটি ঘটেছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পের বেলায়।
সত্যি বলতে, বিশ্ব অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। এমন একটি অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য ঋণ কিংবা তহবিল পাওয়ার সর্বোত্তম উৎস হলো আইএমএফ। বাংলাদেশ যেহেতু ঋণের জন্য মনোনীত হয়েছে, সুতরাং দেশের অর্থনীতির জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক—এ কথা বলাই যায়। কিন্তু খুব ভালোভাবে স্মরণে রাখতে হবে, ‘ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে’। এমতাবস্থায়, যে কোনো সমস্যার মুখে এখন অন্তত দুটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রথমত, এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, আইএমএফের ঋণ প্রবাহ (যেহেতু কয়েক কিস্তিতে অর্থ দেওয়া হবে) যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়। এজন্য অবশ্যই অর্থের ব্যবহারকে ক্রমাগতভাবে নিরীক্ষণে রাখতে হবে। এবং অর্থকে কীভাবে লাভে রূপান্তর করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাকআপ (বিকল্প) প্ল্যান। আইএমএফ যদি কয়েক কিস্তির পর অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়, তখন তো মহা বিপদ! এজন্য ব্যাকআপ প্ল্যান অতি জরুরি। হতে পারে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মতো উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি কিংবা সার্ক বা আসিয়ান থেকে আঞ্চলিক সহায়তা। তবে বাস্তবতা হলো, অর্থ যেখান থেকেই আসুক না কেন, অর্থনৈতিক অস্থিরতার চূড়ান্ত সমাধান হলো ‘উৎপাদন’। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এই কথাকে মাথায় রেখে বাংলাদেশকে অবশ্যই এমন সব উৎপাদন খাতে অর্থব্যয় নিশ্চিত করতে হবে, যা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসবে ও বিওপির ভারসাম্য নিশ্চিত হবে। সত্যিকার অর্থে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তখনই সঠিক ও সফল বলে প্রমাণিত হবে, যদি আগামী ১০ বছরে দেশের অর্থনীতি আজকের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।