বিস্ময়কর হলেও সত্য, আমেরিকার বর্তমান ও সাবেক দুই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেই ন্যাশনাল আর্কাইভ রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্লাসিফাইড ইনফরমেশন-সংক্রান্ত আইন ভঙ্গের তদন্ত করতে স্পেশাল কাউন্সিল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদের দুজনই বা যে কোনো একজন আইন ভঙ্গের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হতে পারেন।
ক্লাসিফাইড ইনফরমেশনকে গুরুত্বানুসারে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে—কনফিডেন্সিয়াল, সিক্রেট ও টপ সিক্রেট। এজাতীয় দলিল-দস্তাবেজ বা কাগজপত্র যে কেউ দেখতে বা পড়তে পারে না। এসব কাগজপত্রের সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, পররাষ্ট্রবিষয়ক বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট, সামরিক বা বেসামরিক চুক্তি পেন্টাগন, সিনেট, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক তথ্যাদি জড়িত থাকায় এগুলোকে সিকিউর্ড নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করতে হয়, যাতে করে সাধারণ জনগণসহ যাদের প্রয়োজনীয় ব্যাকগ্রাউন্ড, নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স নেই, তারা দেখতে না পারেন। এই নিয়ম-নীতির বরখেলাপ আইন ভঙ্গের শামিল এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যা কিনা বড় জরিমানা, দেশদ্রোহিতা বা ১০ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
ক্লাসিফাইড মানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেনসিটিভ তথ্যাদি সম্পূর্ণ কাগজপত্র, যা রাষ্ট্রের বিশেষ গোপনীয় স্থানে তথা ন্যাশনাল আর্কাইভে সংরক্ষণের বিধান ও সুস্পষ্ট আইন বা রুল আছে। যেখানে সাধারণ জনগণ বা কোনো নিরাপত্তাসংক্রান্ত যথাযথ ব্যাকগ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স না থাকলে ওসব দলিল-দস্তাবেজ, কাগজপত্র দেখা বা পড়ার কোনো অধিকার থাকে না। কোনো কারণে, ঘটনাক্রমে বা কারো অবহেলার কারণে ঐ সব ক্লাসিফাইড তথ্যসমৃদ্ধ কাগজপত্রে যথাযথ ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্যদের হাতে গেলে যে বা যাদের অবহেলার (নেগলিজেন্স) কারণে ঘটে, তাদের সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় আনার বিধান রয়েছে।
আইনমন্ত্রী মেরিক গার্লেন্ড ১৮ নভেম্বর ২০২২-এ ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অভিযোগ, নির্বাচনি রেজাল্ট পালটে দেওয়াসহ ক্লাসিফাইড ইনফরমেশন-সংক্রান্ত আইন ভঙ্গের তদন্ত করতে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম কমিশন হিসেবে একসময়ের চিফ ক্রিমিনাল প্রসিকিউটর জেক স্মিথকে স্পেশাল কাউন্সিল নিয়োগ দেন।
এদিকে জানুয়ারি ১৩, ২০২৩-এ মেরিক গারলেন্ড প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট-সংক্রান্ত যৌক্তিকতা ও যথার্থতা তদন্ত করতে অ্যাটর্নি রবার্ট হার্টকে নিয়োগ দেন। উল্লেখ্য, এই রবার্ট হার্ট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরই নিযুক্ত প্রসিকিউটর এবং পরবর্তী সময়ে জজ ছিলেন।
সম্প্রতি সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রানিং মেট মাইক পেন্সের বাসভবনেও ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট পাওয়া যাওয়ায় তার তদন্ত করতে স্পেশাল কাউন্সিল নিয়োগ দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। মাইক পেন্সের ঘটনার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ঘটনার সামঞ্জস্য থাকলেও ট্রাম্পের চেয়ে তা পুরোপুরি ভিন্ন। মাইক পেন্সের মতোই বাইডেনও ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে কিছু ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট নিজেদের অজান্তে অশুভ উদ্দেশ্য ছাড়াই বাসভবনে বা হোয়াইট হাউজের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
বিশেষ কাউন্সিল ‘হার’তার ইনভেস্টিগেশনে বের করবে কেন, কীভাবে, কে বা কার মাধ্যমে কোথায় কোথায় ক্লাসিফাইড ইনফরমেশনসমূহ কী উদ্দেশ্যে নেওয়া হলো এবং বাইডেন ছাড়া অন্য কারো হাতে বা অন্য কেউ সেসব দেখল কি না, তা নির্ধারণ করা। ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট পাওয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাইডেন সেগুলো স্বেচ্ছায় ন্যাশনাল আর্কাইভে পাঠাতে ব্যবস্থা করলেন এবং এফবিআই, বিচার বিভাগসহ অন্য সব দপ্তরের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। যেখানে বিচার বিবেচনার প্রক্রিয়ায় কোনোরূপ বাধা দেওয়া হয়নি। ফলে অপরাধমূলক তৎপরতা বা অপরাধ সংঘটনের কোনো উপাদান পরিলক্ষিত হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বেলায় তা পুরোপুরিই উলটো। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই জেনেশুনে বস্তাবন্দি করে ওসব সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট আছে বলে তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া বা ফিরিয়ে দিতে তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি ফিরিয়ে তো দেনইনি বরং ওখানে কোনোরূপ ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট আছে বলে অস্বীকার করেন। তিনি এফবিআই বা বিচার বিভাগের সঙ্গে কোনোরূপ সহযোগিতা করেননি, বরং বাধা প্রদান করেছেন। এফবিআই কর্তৃক সিক্রেট ডকুমেন্ট জব্দ করা সত্ত্বেও তিনি তা ন্যাশনাল আর্কাইভে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেন, ইনভেস্টিগেশন প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদান করেন।
ক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস ফিরিয়ে দিতে বললেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তা ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করে বলেছেন, ওগুলো ডি ক্লাসিফাইড বা ক্লাসিফাইড নয়, এগুলো তার একান্তই নিজের ডকুমেন্ট। এফবিআই ও ইনভেস্টিগেশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার লোকেরা খারাপ ব্যবহার ও কাজে বাধা প্রদান করেই ক্ষান্ত হননি, তদুপরি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি প্রদান করেন। তার নিজস্ব আইনজীবীর মাধ্যমে চিঠিতে মিথ্যা তথ্য ও ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, সব ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট একসঙ্গেই ফেরত দেওয়া হয়েছে। এমনিতর বৈরী অবস্থার মধ্যেও ইনভেস্টিগেটররা আরো প্রায় ১০০ ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট জব্দ করেন, যেখানে অসংখ্য সিক্রেট ও টপ সিক্রেট ইনফরমেশন বা গোপন সেনসিটিভ তথ্য রয়েছে, যা দেশ বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এসব বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক শাস্তি প্রদানের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যে যতই অপরাধ করুক, দুজনের ইনভেস্টিগেশনই সমান গুরুত্ব দিয়ে বিচার বিভাগ তার কাজ করছে। যে কারণে বাইডেনের বিশেষ কাউন্সিল নির্ধারণ করা হয়েছে ট্রাম্পেরই মনোনীত ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ‘হার’, যিনি অত্যন্ত কনজারভেটিভ রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিগান মনোনীত প্রধান বিচারপতি উইলিয়াম রেনকুইস্টের ক্লার্ক ছিলেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ২০২০-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনি ফলাফল পালটানোর অভিযোগেরও তদন্ত করছে স্মিথ কমিশন। পাশাপাশি জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অফিসও নির্বাচনি ফলাফল পালটানো এবং তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবৈধ চাপ ও হুমকি প্রদানের অভিযোগসমূহের বিচার করছে। সেই বিচার প্রক্রিয়াও প্রায় শেষের দিকে, যে কোনো সময় তা ইনডাইক্টমেন্ট আকারে প্রকাশ হতে পারে। তবে কে কতটুকু আইন লঙ্ঘন করেছেন বা দোষী তা প্রকাশিত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
উল্লেখ্য, সব ক্ষেত্রেই স্পেশাল কাউন্সিল তার সব বিচার-বিবেচনা তদন্ত পর্যালোচনায় বিবাদী দুই নেতার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা, গুরুত্ব ও আইন ভঙ্গের পরিমাণ সম্পর্কে বিচার বিভাগকে অবহিত ও সুপারিশ করবে এবং বিচার বিভাগ প্রদর্শিত আইনানুসারে সাজা বা শাস্তি প্রদান করবে।