বিগত দুই বছরের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকা শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়ামের তথ্য মতে, বছরের ৩১৭ দিন ঢাকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্মল বায়ুর মানমাত্রার চেয়ে খারাপ থাকে। সংস্থাটির এক গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতকালে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকছে। এই দূষণের পেছনে নির্মাণকাজের ধুলো, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ধোঁয়া, ইটভাটাসহ শিল্পকারখানার ধোঁয়া ইত্যাদির পাশাপাশি প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার মারাত্মক ভূমিকা পালন করছে।
সম্প্রতি গবেষকেরা ঢাকার বাতাসে বিষাক্ত অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় ঢাকার মোট ১৩টি এলাকার বাতাসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। মাত্রাতিরিক্ত পলিথিনের উৎপাদন, ব্যবহার, ব্যবহারের পর যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়া এবং পুড়িয়ে ফেলার ফলে বায়ু এবং মাটিতে খুব সহজেই প্লাস্টিকের মিশ্রণ ঘটছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, শহরবাসীর শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে এসব কণা শরীরে প্রবেশ করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মো. আতিকুর রহমান জানান, ‘প্লাস্টিক কণা নিশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে প্রথমে ফুসফুস, পরে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে ক্যানসার থেকে শুরু করে স্নায়ুজনিত নানা রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং শ্বাসজনিত অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে।’ পলিথিন বা প্লাস্টিক দ্রব্যের কারণে পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, একই সঙ্গে পয়োনিষ্কাশনেও জটিলতা ও জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। মাটির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি চাষাবাদেও বাধা তৈরি করছে এই পলিথিন। ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-র প্রেক্ষিতে পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। ২০০২ সাল থেকে তিন-চার বছর পলিথিনের ব্যবহার সীমিত হলেও বর্তমানে যত্রতত্র অবাধে ব্যবহার হচ্ছে। আইন প্রণয়নের ২০ বছর পরও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। ফলে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।
উল্লেখ্য, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মোবারক আহমদ খান ‘সোনালি ব্যাগ’-এর উদ্ভাবন করেন। এটি একটি সেলুলোজ-ভিত্তিক বায়োডিগ্রেডেবল বায়োপ্লাস্টিক। পাট থেকে সেলুলোজ সংগ্রহ করে এই ব্যাগ তৈরি করা হয়। এটি দেখতে সাধারণ পলিথিনের মতো হলেও এটি পচনশীল। পলিথিনের পরিবর্তে সোনালি ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে পারলে তা পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কার্যকরী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা সম্ভব হয়নি। বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসার আগেই ‘সোনালি ব্যাগ’ দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলেছিল। ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে সেই ব্যাগ ছয় বছরেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনা যায়নি।
উদ্ভাবক মোবারক আহমেদ জানান যে, সোনালি ব্যাগ বাজারজাত করতে আরো ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। সরকারের কাছে এই টাকা চেয়ে আবেদনও করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাও খুঁজছেন তিনি। বিজেএমসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ বাজারে আনার ক্ষেত্রে মূল জটিলতা এখন একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যাগ সিলিং মেশিন কেনা; আর দরকার বড় আকারের অর্থায়ন। আর এগুলোর অভাবেই এখন পর্যন্ত সোনালি ব্যাগের বাজারজাতকরণের কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
পরিশেষে ব্যাপারটি দাঁড়াচ্ছে যে, কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যবহার কমানো কিংবা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। পাশাপাশি, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ উৎপাদনেও কার্যকরী পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি কি দুঃখজনক নয়?