তিন দিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে একটি রহস্যময় সাদা বেলুন। এ ঘটনায় বিশ্বব্যাপী একধরনের হইচই পড়ে গেছে। বেলুনটিকে চীনের ‘গুপ্তচর বেলুন’ বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে বেলুনটিকে প্রথম দেখা যায় গত ২ ফেব্রুয়ারি। এরপর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেলেও বেলুনটিকে এখনো ভূপাতিত করেনি পেন্টাগন। পেন্টাগনের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে বেলুনটিকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে।’ বলা বাহুল্য, আমেরিকার আকাশে চীনা বেলুন ওড়ার ঘটনা তথা ‘বেলুন ইস্যু’ ক্রমশ উত্তাপ বাড়াচ্ছে বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বেলুনটি প্রথম দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার আকাশে। ধারণা করা হচ্ছে, মন্টানার বিলিংস শহরের আকাশে দেখা যাওয়ার আগে বেলুনটি আলাস্কার অ্যালেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও কানাডার ওপর দিয়ে উড়ে এসেছে। এ ঘটনায় চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এটি একটি বেসামরিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষক বেলুন। নির্ধারিত পথ থেকে সরে গিয়ে তা যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। এ ঘটনায় আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।’ যদিও চীনের এই দাবি মানতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে নজরদারি চালাতেই ব্যবহার করা হয়েছে এই ‘গুপ্তচর বেলুন’। তবে ঘটনা যা-ই হোক না কেন, ‘বেলুন ইস্যু’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কে আরেক দফা অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বলে রাখা দরকার, মন্টানার আকাশে বিশেষ করে চীনা বেলুনের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যে মাথাব্যথার বড় কারণ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কেননা, মন্টানার মালমস্ট্রম বিমানঘাঁটিতে মার্কিন সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা রয়েছে। আমেরিকায় যে তিনটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষেত্র রয়েছে, তার একটি অবস্থিত এই এলাকায়। অর্থাৎ এহেন স্পর্শকাতর এলাকার আকাশে চীনের বেলুন ওড়ার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশ চিন্তার বিষয়। কিন্তু অবাক বিস্ময় হলো, এ নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে না পেন্টাগনকে, যতটা হওয়ার কথা! বিষয়টি সত্যিই আশ্চর্যজনক! পেন্টাগন বলেছে, ‘বেলুনটি যে চীনা, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এবং চীন এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রকে শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করেছে।’
এ-ও বলে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে বেলুন ওড়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়, আগেও আমেরিকার আকাশে ‘রহস্যজনক বেলুন’ উড়তে দেখা গেছে। পেন্টাগনের মুখপাত্র ব্র্রিগেডিয়ার জেনারেল প্যাট রাইডারও বলছেন একই কথা—‘গত কয়েক বছর ধরে এ ধরনের কার্যকলাপ লক্ষ করছি আমরা।…সংবেদনশীল তথ্য হাতিয়ে নিতে এ ধরনের অপতত্পরতা চালানো হচ্ছে কি না, তা-ও পর্যবেক্ষণে রেখেছি আমরা।’
যা হোক, এ ঘটনায় বেশ কিছু প্রশ্ন উঠতে পারে। যেমন—‘শক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা’ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আকাশসীমায় কীভাবে একটি বিদেশি বেলুন প্রবেশ করতে পারল কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই? অত্যন্ত স্পর্শকাতর সামরিক স্থপনাসমৃদ্ধ আকাশসীমা লঙ্ঘন সত্ত্বেও মার্কিন প্রশাসনকে ‘শান্ত’ থাকতে বলা চীনের আহ্বানের কী কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে? বেলুন যদি আদৌ ‘নজরদারি’র কাজে ব্যবহৃত না হয়ে থাকে, তাতেও কি যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? এখনই এসব প্রশ্নের উত্তর মেলানো কঠিন। তবে এখন পর্যন্ত অন্তত এটা পরিষ্কার যে, বিষয়টিকে খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি বাইডেন প্রশাসন। চীনা বেলুন নিয়ে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে চীন সফর স্থগিত করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন (রবিবারে চীন সফরে যাওয়ার কথা ছিল ব্লিনকেনের)।
সত্যি বলতে, এ ঘটনা বেশ উত্তাপ ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে। মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। অনেককে এমনটাও বলতে শোনা গেছে, ‘প্রশাসন কী এটা চায় যে, আমরা মার্কিন আকাশে চীনের অনুপ্রবেশকে খুব একটা বড় ব্যাপার হিসেবে না দেখি? যদি তা না হয়, তবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হোক।’ প্রকৃতপক্ষে বেলুনটি এতটাই উচ্চতায় অবস্থান করছিল যে, তা নজরদারির জন্যই ব্যবহার করা হতে পারে বলে ধরে নেওয়াটা বাড়াবাড়ি হবে না। তা যদি না-ও হয়, তবে এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে, এ ধরনের বেলুন অস্ত্র-সরঞ্জাম বহন করতে পারে খুব সহজেই। সুতরাং, ঘটনাটিকে খুব ছোট করে দেখাটা হবে ‘মারাত্মক ভুল’।
লক্ষণীয় বিষয়, বেলুনটি এতটাই উচ্চতায় ছিল যে, তা বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের উচ্চতার চেয়েও অনেক ওপরে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, এতটা উচ্চতায় কী করছিল বেলুনটি? তাছাড়া বেলুনটি প্রথম দেখেন একজন বিমানযাত্রী। সুতরাং স্বভাবতই উঠতে পারে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—বেলুনটি ‘অত্যন্ত শক্তিশালী’ মার্কিন নিরাপত্তা ব্যবস্থার চোখ ফাঁকি দিল কীভাবে? বেলুনটিকে নিরাপত্তাব্যবস্থা সর্বপ্রথম সনাক্ত করতে পারল না কেন? সত্যিই, এসব তো অবাক করার মতো বিষয়!
এবং আরো একটি বিষয়, সামরিক বাহিনী বেলুনটিকে গুলি করে ভূপতিত করেনি। তাদের যুক্তি, এতে ‘ধ্বংসাত্মক’ বস্তু থাকতে পারে, যা বেসামরিক হতাহত ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, মন্টানার জনসংখ্যার ঘনত্ব তো খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ‘খোঁড়া যুক্তি’ দেখানো হলো কেন?
আশ্চর্য হওয়ার মতো তথ্য, বেলুন গোয়েন্দা নজরদারির সবচেয়ে পুরোনো পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে অগ্নিসংযোগ ও বোমা হামলা করতে জাপানিরা বেলুন ব্যবহার করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও ব্যাপকভাবে নজরদারি করতে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বেলুন ব্যবহার করেছিল। এর কারণ, বেলুন কম ব্যয়বহুল এবং খুব সহজেই মোতায়েন করা যায়। তাছাড়া স্যাটেলাইট তার নিজের কক্ষপথেই ঘুরতে থাকে, কিন্তু বেলুন যেকোনো জায়গায় পাঠানো যায় সহজেই। এমন এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রশাসন যত যুক্তিই দেখাক না কেন, ‘চরম শঙ্কা’ থেকেই যাচ্ছে। সুতরাং, আমেরিকার আকাশে চীনা বেলুন ওড়ার ঘটনাকে এক কথায় বলা যায়—‘ভাল বিষয় নয় আদৌ’।
আবার এই সম্ভাবনাকেও দূরে রাখা যাবে না, চীন নতুন কোনো নজরদারি কৌশল খুঁজছিল কি না। আমেরিকার মহাদেশীয় বিমান প্রতিরক্ষা আসলে কতটা ভালো কাজ করে, কতটা তীক্ষ ও শক্তিশালী—এ সবই হয়তো পরীক্ষা করে দেখছিল চীনা বেলুনটি। এই অবস্থায় দুটি বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যায়—প্রথমত, অধিক উচ্চতায় কি মার্কিন ‘নিরাপত্তা সিস্টেম’ কাজ করে না (বিষয়টি আশ্চর্যজনক বটে)? দ্বিতীয়ত, ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় প্রবেশে বাধা না দেওয়ার পেছনে মার্কিন প্রশাসনের কি ‘অন্য’ কোনো উদ্দেশ্য বা কৌশল আছে?
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত উড়ন্ত বেলুনটিকে কঠোরভাবে ‘ট্র্যাক’ করে রাখা হয়েছে। পেন্টাগন কর্মকর্তারা বোঝার চেষ্টা করছেন, ঘটনাটা আদতে কী? তবে ঘটনা যা-ই হোক না কেন, বাইডেন প্রশাসনকে চীনের এই অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়ে ‘রাজনৈতিক যুক্তি’ ব্যাখ্যা করতে হবে জনগণের কাছে। একই সঙ্গে কেন কোনো ‘তৎক্ষণাৎ কড়া আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ’ জানায়নি প্রশাসন, তার ব্যাখ্যাও দিতে হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমেরিকার ভূখণ্ডে চীনা বেলুন মার্কিন কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। আমেরিকার প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে এখন যদি কেউ ‘দুর্বল’ বলে অবিহিত করে, তবে প্রশাসন কী তার বিরোধিতা করার যুক্তি খুঁজে পাবে? যদি না পায়, তবে সত্যি সত্যিই সামরিক, রাজনৈতিক বা যে কোনো দুর্বলতার জন্য বাইডেনকে আমেরিকার জনগণের মুখোমুখি হতে হবে একটা না একটা সময়।