সেদিন স্নাতকোত্তরের প্রথম ক্লাস করছিলাম। ক্লাস নিতে এলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সবচেয়ে অভিজ্ঞ অধ্যাপক চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। আমাদের সঙ্গে দুটি বিষয় থাকলেও সেদিন তিনি পাঠদান করালেন ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচিং (English Language Teaching)-এর ওপর। কিছুক্ষণ বিষয়টির ওপর বলার একপর্যায়ে বললেন, ‘বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেদেশে অন্যভাষা শেখাটা আবশ্যিক, মাতৃভাষা নয়।’ আমাদের কিছুটা কম বোধগম্য হওয়াতে তিনি আরো ব্যাখ্যা করে বুঝালেন, অনেকটা এভাবে পৃথিবীতে আরেকটি দেশও নেই, যেদেশে তাদের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য আরেকটি ভাষা আমাদের মতো শিক্ষাব্যবস্থায় আবশ্যিক শেখানো হয়। অথচ আমাদের দেশে ইংরেজি একটি প্রাতিষ্ঠানিক আবশ্যিক বিষয়। যার কারণে এদেশের অলিতেগলিতে হরেকরকম প্রতিষ্ঠান শুধু ইংরেজি ভাষা শেখানোর জন্য। পক্ষান্তরে, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হয়েও, যে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি বলে গর্ব করি, তা শেখানোর প্রয়োজনে আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, যেখানে ইংরেজি আমাদের দেশে আবশ্যিক একটি বিষয়, ঠিক একই দেশে মাতৃভাষা বাংলা আবশ্যিক নয়। যে কারণে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে বাংলা বলতে কিছু নেই। এখানেই তো আমাদের দেশপ্রেম বোঝা যায়। তিনি একই সঙ্গে এসব নিয়ে কেউ কথাও বলে না কিংবা এ বিষয়ে কেউ আওয়াজ তুললেও গুরুত্ব না পাওয়ার বিষয়ে হতাশাও প্রকাশ করলেন।
তার কথাগুলো হা করে আমরা শুনে গোগ্রাসে গিলেছি শুধু। ভেবে দেখেছি এরচেয়ে চরম সত্য আসলে আমার দেশে আর নেই। আরেকটি ঘটনা এখানে বলা প্রয়োজন মনে করি। একদিন গৃহশিক্ষক চেয়ে আমার এক সহপাঠী জানালেন, অভিভাবকের চাওয়া, শিক্ষককে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করা হতে হবে, সঙ্গে সিজিপিএ (স্নাতক ফলাফল) ৩ শতাংশ লাগবে। শিক্ষার্থী ইংলিশ মিডিয়ামে কেবল প্রথম আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। বিষয়টি ভাবনার হতো না, যদি একটা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের বিষয় হতো। এমন চাহিদা যে, স্নাতক শেষ করে একজন শিক্ষার্থী চাকরি না খুঁজে গৃহশিক্ষকের পেশা বেচে নিচ্ছে। ইংলিশ মিডিয়াম তাই বলে কি স্নাতক সম্পন্ন করতে হবে, তাও আবার প্রথম শ্রেণির সনদ নিয়ে গৃহশিক্ষক হওয়ার জন্য? এদেশে সবই সম্ভব। তাইতো বাংলা মায়ের গর্বিত সন্তানেরা প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষার জন্য, যেদিন বঙ্গাব্দ ছিল ৮ই ফাল্গুন। অথচ আমরা পালন করছি খ্রি. ২১ ফেব্রুয়ারি।
ভাষার মাস, দেশের অর্জনে-গর্জনে যার নাম সবসময় উজ্জ্বল। যে ভাষার মান রক্ষার জন্য সেদিন প্রাণ বিলাতে হয়েছিল শহিদ সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতদের। তবে আফসোস, আমরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমার মায়ের ভাষার আবশ্যিক রূপ দিতে পারছি না। সুদূর সিয়েরালিয়নের মতো দেশ কিংবা ইউনেসকোর মতো সংস্থা যেখানে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির মর্যাদা বুঝতে পারল, আমার ভাষা হয়ে আমরা কি সেটুকু বুঝেছি? বুঝলে আজ ইংলিশ মিডিয়াম কিংবা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাতে কেন বাংলা শেখা আবশ্যিক হলো না? কোনো প্রতিষ্ঠানেও দেখা হয় না চাকরিপ্রার্থীর বাংলায় (আলাদা) দক্ষতা কেমন? তবে কি অমর একুশে কথাটাই ক্লিশে নয়? তাইতো এটা বলাতে দ্বিধা নেই, ভাষার মাসই আমাদের দেশপ্রেমের মাপকাঠি। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগগুলোতেও বাংলা সাহিত্য নিয়ে কোনো পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত নেই। আমাদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোনোটাতেই বাংলা সাহিত্যের কোনো বিষয় পড়ানো হয় না। অথচ বাংলা সাহিত্য বিভাগ থেকে শুরু করে অন্যসব বিভাগের চিত্র ঠিক তার উলটো। ওখানে আবশ্যিকভাবে ইংরেজি শেখার আলাদা পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত। এ যেন এক মায়ের দুই রূপ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ যে জাতি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়ে সেদিন ভাষার মান রক্ষায় প্রাণ বিসর্জন করেছিল, সেদিনের তারা আজ বেঁচে থাকলে আরেকবার মিছিলে যেত। তাই আসুন, আওয়াজ তুলি শিক্ষাব্যবস্থায় আবশ্যিক হোক আমার বাংলা, আমার মায়ের ভাষা। কথায় কথায় ইংরেজি বলতে পারা ছেলেটা নয়, কবি কুসুম কুমারীর আদর্শ আর মেধাবী ছেলেটা সেই হোক, যার বাংলা ভালো; কবি অতুলপ্রসাদ সেনের মোদের গরব, সেই হোক যে বাংলায় পটু।