আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে আমাদের পরিবেশ—এ লাইনটির সঙ্গে অল্পবিস্তর আমরা সবাই পরিচিত। পরিবেশের গুরুত্ব কতটুকু তাও আমরা জানি। জেনেও প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি আমাদের লাগামহীন উদাসীনতা, সত্যই পীড়াদায়ক! পরিবেশে আমাদের বসবাস, জীবনধারণ। গাছ-নদী-নালা-পাহাড়-পশু-পাখি-কীটপতঙ্গ তথা জড়জীব সবকিছু নিয়েই পরিবেশ। এই পরিবেশ সুন্দর রাখার দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি তা করি? বরং আমাদের কাজকর্মে পরিবেশ দিনদিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। বাস্তুতন্ত্র হচ্ছে বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
আমরা পশুপাখির প্রতি নির্দয় আচরণে পিছপা হই না। নির্বিচারে গাছনিধন ও বন ধ্বংস করছি। নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের কাজকর্মে। নির্মল বায়ু হচ্ছে দূষিত। প্রমত্তা নদী হচ্ছে মরাগাঙ। দিনদিন মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরাশক্তি। জলজ-স্থলজ সব প্রাণীই আজ হুমকির সম্মুখীন। স্বার্থের মোহে আমরা কতটা অন্ধ হতে পারি, তার নমুনা মাঝেমধ্যেই পত্রিকার বড় বড় হেডলাইনগুলোই স্পষ্ট করে দেয়! ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা আজ আমরা ভুলতে বসেছি। আজকাল অসময়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় বেড়েই চলছে। প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। আজ পানিদূষণ-বায়ুদূষণ-শব্দদূষণ কতশত দূষণে আমরা জর্জরিত!
একটু রাজধানী ঢাকার দিকে লক্ষ করুন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ঢাকা শহর আজ বিশ্বের দূষিত শহরের একটি। শুধু কি তা-ই, বরং এটি এই তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও যানজট এ শহরের নিত্যসঙ্গী। একদার এ শহরটির চারপাশের প্রমত্তা নদীগুলো আজ বড়ই অসহায়। বুড়িগঙ্গা নদীর অবস্থা দেখলেই ঢাকার পরিবেশদূষণ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা বুঝতে কারো পরিবেশবিদ্যায় ডিগ্রিধারী হওয়ার প্রয়োজন নেই! অথচ এই নদীগুলোতেই একসময় দেখা যেত রংবেরঙের পালতোলা নৌকার। মানুষ এগুলোর স্বচ্ছ ও সুন্দর পানি ব্যবহার করত দৈনন্দিন কাজে। ঢাকা শহরের নদীর ওপর দিয়ে আজ নৌকা পারাপারেও দম আটকে আসে, পানির দুর্গন্ধে! যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনার উপস্থিতি লক্ষণীয় হারে বাড়ছে শহরের অলিগলি-রাস্তাঘাট এমনকি উড়ালসেতুগুলোর নিচেও, যা যারপরনাই নগরবাসীর বিরক্তির কারণ।
আজ গ্রামের সুন্দর, নির্মল পরিবেশও নানাভাবে হচ্ছে দূষণের শিকার। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা যেন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমরা অনেকেই কোথাও বেড়াতে গিয়ে কিংবা রাস্তাঘাটে যানবাহনে হাতের চানাচুরের প্যাকেটটি বা পানির বোতলটি ফেলতে দ্বিধা বোধ করি না। অধিকাংশ পর্যটন এলাকা কিংবা নদী থেকে টনের পর টন প্লাস্টিক বর্জ্য উত্তোলন, আমাদের অসচেতনতাকেই সামনে নিয়ে আসে। বর্জ্য বা ময়লা সঠিক স্থানে না ফেলার দরুন তা আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হচ্ছে। আজকাল হাসপাতালে রোগীর ক্রমবর্ধমান চাপ কী ইঙ্গিত করে? আসলে, আমাদের অসচেতনতাই রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ার উল্লেখযোগ্য কারণ। আমরা যত জানি, মানি তত কম! অন্যদিকে বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থাও অতিশয় দুর্বল আমাদের দেশে। বর্জ্য ফেলা হয় এমন সব জায়গায়, যেখান থেকে পরিবেশ দূষিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। যারা এ দায়িত্বে থাকেন তারাও যেন এগুলো যেনতেনভাবে ফেলে দিয়ে বেঁচে যেতে যান, যা কখনো কাম্য নয়।
এই যে বর্জ্য নিয়ে এত কথা। অথচ এ বর্জ্যকেও কাজে লাগানো যায়। পৃথিবীর অনেক দেশ বর্জ্যকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগাচ্ছে। ই-বর্জ্য থেকে নতুন জিনিস তৈরি করে সেগুলো বাজারজাত করা হচ্ছে। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়, তাকে বোঝা না ভেবে বরং সম্ভাবনা হিসেবে নিতে হবে। পাশাপাশি সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বর্জ্য নিষ্কাশন ও এর ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আসলে, আমরা শিল্পবাণিজ্য অবকাঠামো তথা উন্নয়নমূলক কাছে যতটা উত্সাহী, ততটাই অসচেতন টেকসই উন্নয়নে! যে উন্নয়ন দূষণ বাড়ায়, তা স্থায়ী হতে পারে না। কাজেই উন্নয়নই যথেষ্ট নয়, চাই টেকসই ও কল্যাণমুখী উন্নয়ন। আসুন, পরিবেশদূষণ রোধ করি। নিজের জায়গা থেকে সচেতন থেকে দেশের টেকসই উন্নয়নে সংকল্পবদ্ধ হই।