নবায়নযোগ্য শক্তি বা রিনিউঅ্যাবল এনার্জি হলো এমন শক্তির উৎস, যা স্বল্পসময়ের ব্যবধানে পুনরায় ব্যবহার করা যায় এবং এর ফলে শক্তির উৎসটি নিঃশেষ হয়ে যায় না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস, যেমন :সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, ভূতাপ, সমুদ্রতরঙ্গ, সমুদ্রতাপ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। সারা পৃথিবীতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন দিনদিন বাড়ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদার ৮৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি বা রিনিউঅ্যাবল এনার্জি থেকে পূরণ করা হবে। অধিকাংশ দেশ তাদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়যোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।
নবায়নযোগ্য শক্তিসমূহ পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন নিঃসারণমুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং একটি টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী আন্দোলনসমূহ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে উত্সাহ অব্যাহত রেখেছে। বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির অধিকাংশ ব্যয় হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে, মোটরযান চলাচলে এবং বাসা বাড়ির তাপ উৎপাদনে। প্রধানত দুটি উপায়ে সূর্য থেকে শক্তি সংগ্রহ করা যায়। প্রথমত, সূর্য থেকে আলোক শক্তি সংগ্রহ করে, দ্বিতীয়ত, সূর্য থেকে তাপশক্তি সংগ্রহ করে। আলোক সংবেদী অর্ধপরিবাহী দ্বারা তৈরি ফোটোভোল্টাইক সেল (পিভি) ব্যবহার করে তৈরি করা হয় সোলার প্যানেল। এসব প্যানেলের বিশাল অ্যারে বা শ্রেণি তৈরি করে আলোক শক্তি থেকে ডাইরেক্ট কারেন্ট বা ডিসি বিদ্যুৎশক্তি সংগ্রহ করা হয়। তাপশক্তি সংগ্রহ করার জন্য ব্যবহার করা হয় কনসেন্ট্রেটেড সোলার পাওয়ার বা ‘কেন্দ্রীভূত সৌরশক্তি পদ্ধতি’। অনেকগুলো দর্পণের সাহায্যে সূর্যের আলোককে একটি টাওয়ার বা মিনারের অগ্রভাবে প্রতিফলিত করা হয়। সব দর্পণের এই কেন্দ্রীভূত প্রতিফলনের ফলে সৃষ্ট তাপকে কাজে লাগিয়ে বাষ্প তৈরি করা হয়, যা থেকে পরে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। এছাড়াও বাড়ির ছাদে জল গরম করার জন্য ব্যবহার করা যায় সৌর-জল-উত্তাপক বা সোলার ওয়াটার হিটার। শীতপ্রধান দেশে বা কলকারখানার গরম পানির চাহিদা মেটাতে এটি ব্যবহার করা হয়।
প্রতিদিন পৃথিবীতে এক ঘণ্টায় যে পরিমাণ সৌরশক্তি পৌঁছায় তা দিয়ে পুরো পৃথিবীর দুই বছরের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো যাবে। বায়ুপ্রবাহ হয়ে থাকে তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে। এটি মূলত সৌরশক্তিরই আরেক রূপ। বায়ুর গতিতে থাকে গতিশক্তি বা কাইনেটিক এনার্জি। এই গতি শক্তিকে সাধারণত টারবাইনের মাধ্যমে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। বায়ুমণ্ডলের যত ওপরে যাওয়া যায়, ততই স্থির বেগের বায়ুপ্রবাহ পাওয়া যায়। তাই উঁচু টাওয়ারের মাথায় বায়ুকল বসিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। বায়ুকলগুলো সাধারণত শ্রেণিবদ্ধভাবে বসানো হয়। যেখানে বায়ুকলগুলো বসানো হবে, তার আগে প্রায় দুই-তিন বছরের বায়ুপ্রবাহের গতি পর্যালোচনা করে দেখা হয়, সেখানে বছর জুড়ে যথেষ্ট বায়ুপ্রবাহ আছে কি না। স্থলভূমিতে বায়ুকল বসালে তাকে বলা হয় অন-শোর-উইন্ড বা ভূমিস্থ বায়ুশক্তি। আর সমুদ্রে, যেখানে তুলনামূলক বেশি বায়ু প্রবাহ পাওয়া যায়, সেখানে বসালে তাকে বলা হয় অফ-শোর-উইন্ড’ বা সামুদ্রিক বায়ুশক্তি। বর্তমানে চীন বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ভারতও বায়ুশক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে।
মানুষ অথবা পশুপাখির বিষ্ঠা এবং পচনশীল আবর্জনা থেকে বায়োগ্যাস তৈরি করা যায়, যা রান্নার কাজে বা বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগে—কিছু বিশেষ ধরনের শর্করা উৎপাদক শস্য; যেমন :সয়াবিন, আখ ইত্যাদি গাছ থেকে বায়োফুয়েল তৈরি করা যায়। গাঁজন প্রক্রিয়ায় শর্করা থেকে মেথানল, ইথানল অথবা সরাসরি জ্বালানি হাইড্রোকার্বন প্রস্তুত করা যায়। এই ফুয়েল সরাসরি যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করে সমুদ্রের পানি, বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড ও সূর্যালোক থেকে বায়োফুয়েল তৈরির গবেষণা চলছে। গাছপালা যেগুলো বপনের ২৫-৩০ বছরের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষে পরিণত হতে পারে, সেগুলো ব্যবহার করেও বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন করা যায়। গাছের কাঠ উচ্চ কর্মদক্ষতাসম্পন্ন চুল্লিতে পুড়িয়ে তাপ পাওয়া যায়। সেই তাপে পানি বাষ্প করে টারবাইন চালিয়ে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। একটি ম্যানেজড ফরেস্ট বা পরিকল্পিত বনে এমনভাবে হিসাব করে গাছ কাটা ও লাগানো হয়, যাতে করে ঐ বনে মোট গাছের সংখ্যা কখনই না কমে, বরং বাড়ে। এই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বলা হয়, বায়োম্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিভিন্ন ফসলের উচ্ছিষ্টাংশ, খড়, চিটা কাজে লাগিয়েও এই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যায়। এটি একটি কার্বন নিউট্রাল প্রক্রিয়া। সমুদ্র থেকে বিভিন্ন উপায়ে নবায়নযোগ্য শক্তি সংগ্রহ করা যায়। এর মধ্যে প্রচলিত কয়েকটির বর্ণনা হলো—সমুদ্রের তরঙ্গ বা ঢেউতে রয়েছে গতিশক্তি ও যান্ত্রিক শক্তি। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ওঠানামা করতে পারে, এমন ভাসমান বয়ার নড়াচড়াকে কাজে লাগিয়ে ফ্লুইডকে (বাতাস অথবা পানিকে) প্রেশারাইজড করা হয়। সেই ফ্লুইডের চাপে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
ওশেন থার্মাল এনার্জি কনভার্শন (ওটেক) বা সমুদ্র তাপশক্তি থেকে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা যায়। সমুদ্রের উপরিতলের তাপমাত্রা থাকে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর প্রায় এক কিলোমিটার নিচে গেলেই এই তাপমাত্রা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি। এই তাপমাত্রার পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে কম স্ফুটনাঙ্কবিশিষ্ট তরল যেমন অ্যামোনিয়ার প্রসারণ দ্বারা টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। জোয়ার-ভাটার সময় দিনে দুই বার করে সমুদ্রের পানির উচ্চতা কমবেশি হয়। বাঁধ দিয়ে এই উচ্চতার পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
জিওথার্মাল এনার্জি বা ভূতাপশক্তি হলো পৃথিবীর অভ্যন্তরের শক্তি। পৃথিবীর কেন্দ্র একটি গলিত ধাতুর পিণ্ড যার তাপমাত্রা প্রায় ৬ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সেই তাপমাত্রা পৃথিবী পৃষ্ঠের নিচ পর্যন্ত পরিচালন পদ্ধতিতে চলে আসে। তাছাড়াও পৃথিবীর অভ্যন্তরের তেজষ্ক্রিয় পদার্থ; যেমন :থোরিয়াম, ইউরেনিয়ামের ক্ষয়ের ফলে যে তাপ সৃষ্টি হয় সেটিও ভূপৃষ্ঠের নিচ পর্যন্ত পরিচালিত হয়। এই তাপকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়। সাধারণ যেসব জায়গায় টেকটনিক প্লেটের কিনারা আছে বা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে, সেখানে ভূপৃষ্ঠের প্রায় এক-দুই কিলোমিটার নিচে পাইপ দিয়ে পানি চালনা করে বাষ্প করা হয়, যা থেকে পরবর্তী সময়ে টারবাইন চালানো করে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। আইসল্যান্ডের বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ আসে ভূতাপশক্তি থেকে। কয়েক প্রকারের ভূতাপশক্তি কেন্দ্র রয়েছে। যেমন :শক্তির সব থেকে পরিচিত মাধ্যমটি হলো জলবিদ্যুৎ। সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় নদীর বুকে বিশাল আকৃতির বাঁধ দিয়ে পানির উচ্চতা বাড়ানো হয়। সেই পানিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে নিচে পড়তে দিয়ে তার ধাক্কায় টারবাইন ঘোরানো হয়। এভাবে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়াও স্রোতস্বিনী নদীতে বাঁধা দিয়ে ‘রান অব দ্য রিভার হাইড্রো পাওয়ার’ তৈরি করা যায়। এছাড়াও মাইক্রো হাইড্রো বা পিকো হাইড্রোর মতো ব্যবস্থাও আছে, যেখানে ছোট পাহাড়ি ছড়ার স্রোতে টারবাইন চালিয়ে স্বল্পমাত্রায় বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
শহুরে আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ বা ‘মিউনিসিপ্যালিটি ওয়েস্ট টু এনার্জি’ বর্তমান যুগে দারুণ জনপ্রিয় একটি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন মাধ্যম। প্রতিটি মেগাসিটি বা বড় শহরে প্রতিদিন কয়েক লাখ টন সলিড-ওয়েস্ট বা আবর্জনা তৈরি হয়। এই আবর্জনাগুলো থেকে দাহ্য পদার্থ; যেমন :প্লাস্টিক, কাঠখড় ইত্যাদি বাছাই করে আলাদা করা হয়। সেগুলো দক্ষ ফার্নেসে পুড়িয়ে বাষ্প তৈরি করে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। উৎপন্ন গ্যাসকে বিভিন্ন উপায়ে পরিশোধন করে বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেওয়া হয়। শহরের পচনশীল আবর্জনা এবং পয়োনিষ্কাশিত আবর্জনা থেকে বায়োগ্যাস তৈরি করে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। কাজেই আমাদের সম্ভাব্য নবায়নযোগ্য শক্তি কাজে লাগানোর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা একান্ত প্রয়োজন।