মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বছর দুয়েক আগে সেনা অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। সামরিক নেতৃত্বের সেই অভ্যুত্থানের হাত ধরে দেশটিতে তৈরি হয় নানা অস্থিরতা। এরই ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যা ক্রমশ গভীরতর হচ্ছে। ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক নিবন্ধে বলা হয়, অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, আগামী অর্থবছরে মিয়ানমারের অর্থনীতি মাত্র ৩ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেতে পারে। এর অর্থ, অদূর ভবিষ্যতে দেশটির অর্থনীতি গুটিয়ে যাবে। এমনকি চরম নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তে পারে দেশটির আর্থিক খাত।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির পর তথা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারের অর্থনীতি ১৮ শতাংশের বেশি সংকুচিত হয়েছে। মূলত জান্তা সরকারের অপিরণামদর্শী কর্মকাণ্ড ও অব্যবস্থাপনার কারণেই দেশটির অর্থনীতির এই বেহাল দশা। এর সঙ্গে সামরিক নেতাদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার অভিঘাতে দেশটিতে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, তার উত্তাপ এসে লাগে অর্থনীতির গায়ে। ‘একটি গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ প্রণয়নে জান্তা সরকারের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান চাপ ছিল, যা এখনো আছে। কিন্তু গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা জান্তা সরকার গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে যেন নারাজ! এ কারণে দেশটিতে অস্থিরতা কেবল বাড়ছেই। ফলে বহুমুখী অর্থনৈতিক সমস্যা আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছে মিয়ানমারকে।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ঘাটতি ও ব্যাংকিং খাতে ‘অস্বাভাবিক নিয়মবহির্ভূত’ কর্মকাণ্ডের কারণে দেশটিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা দিনকে দিন কঠিনতর হয়ে পড়ছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক খাতকে প্রতিনিয়ত জটিল সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এক জরিপের হিসাব অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের আগে অন্তত ১২৭টির মতো বড় বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ ছিল মিয়ানমারে। কিন্তু পরবর্তীকালে অস্থিতিশীলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকসানের মুখে পড়ার ভয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় অনেক কোম্পানি। যারা থেকে যায়, তাদের অবস্থাও এখন সঙ্গিন। এতে করে নতুন বিনিয়োগের আশা করা দেশটির জন্য স্বভাবতই এক প্রকার ‘অসম্ভব কল্পনা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বনামধন্য টোরিনো ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ২৮টি বড় বহুজাতিক কোম্পানি মিয়ানমার ছেড়েছে কিংবা ব্যাবসায়িক কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনেও। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের পর প্রথম বছরেই ক্রমবর্ধমান হারে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কোম্পানি মিয়ানমার থেকে চলে যায়। যারা থেকে যায়, অবস্থার পরিবর্তন না হলে তাদেরও চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তার বাস্তব চিত্র দেখা যাচ্ছে এখন। যেমন, চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে মিয়ানমারে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ব্রিটিশ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার। এর কারণ, কোম্পানিটি মনে করে, জান্তা সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি মেনে দেশটিতে দায়িত্বশীল ব্যাবসায়িক আচরণের ক্ষেত্র বজায় রাখা অসম্ভব ও কঠিন। এর আগে গত বছর ডিসেম্বরে ইয়াঙ্গুন অফিস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার সেন্টার ফর রেসপন্সিবল বিজনেস নামক একটি এনজিও। প্রতিষ্ঠানটি মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য মধ্যস্থতার কাজ করত। এভাবে তৃতীয় পক্ষের (বিনিয়োগ মধ্যস্থতাকারী) মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মাসুল গুনছে জান্তা সরকার। বলে রাখা দরকার, এই বছরের শুরুর দিকে বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগে এনজিওটির প্রতিষ্ঠাতা ও মিয়ানমারে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের সাবেক রাষ্ট্রদূত ভিকি বোম্যানকে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে আটক ও কারারুদ্ধ করে রেখেছিল জান্তা সরকার। যাহোক, এভাবে একের পর এক বিদেশি সংস্থা ও কোম্পানির দেশ ছেড়ে যাওয়ার কারণে মিয়ানমারের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান গতিতে নিমজ্জিত হচ্ছে খাদের গভীরে। এর ফলে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলো যে জান্তা সরকারের জন্য ‘অতি খারাপ’ হতে চলেছে, সে কথা কে না বলবে?
মজার ব্যাপার হলো, বসে নেই জান্তা সরকারও! বরং একটা ‘পরিকল্পনা’ নিয়ে এগোচ্ছে জান্তা নেতৃত্ব। আগামী বছরের মধ্যে দেশে ‘নির্বাচন’ করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ব্যাবসায়িক আস্থা ফিরিয়ে আনার আশা করছে সরকার। এই কথা বাজারে প্রচার করে জান্তা নেতারা এটা দেখাতে চাইছেন যে, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে মিয়ানমারে। ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে দেশে—এমন কথাও বলে বেড়াচ্ছেন নেতারা। এমনকি দেশে ‘স্বাভাবিক পরিবেশ’ বিরাজ করছে বলে প্রচার করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সামরিক শাসনকে ‘বৈধ’ করিয়ে নেওয়ার আশাও করছে জান্তা সরকার!
২ ফেব্রুয়ারি চলমান জরুরি অবস্থা আরো ছয় মাসের জন্য বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে জান্তা নেতৃত্ব। আগামী আগস্টের আগে জান্তার নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা আছে যদিও, কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যেভাবে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে তাতে নির্বাচন সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। যদিও এসব সত্ত্বেও সম্প্রতি ‘নতুন শাসনব্যবস্থা’ আয়োজনের পথে হাঁটার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিছু প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও বলেছে সরকার। কিন্তু এ কথা বলতেই হয়, গণতন্ত্র ব্যতীত ‘সামরিক বৈধতা অর্জনের জন্য’ জান্তা সরকার যত পরিকল্পনাই করুক না কেন, তা আলোর মুখ দেখবে না। নিজের মতো করে জান্তা সরকার যে নির্বাচন আয়োজনের চিন্তা করছে, তা হবে সম্পূর্ণরূপে ‘জাল ও পাতানো’—অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় এ কথা।
২৫ জানুয়ারি জান্তা সরকার একটি আইন জারি করেছে। ২০ পৃষ্ঠার এই আইনে এমন সব শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা মেনে নিয়ে আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। আইনে যেসব বিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা সম্ভবত ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিকে নির্বাচন থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার চিন্তা থেকেই করা হয়েছে। বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের চোখে এসব শর্ত ও বিধিবিধান ‘অবৈধ’ বলেই প্রতীয়মান হবে—এ কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। অথচ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জান্তা সরকারকে এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছেন, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু ব্লিঙ্কেনের আহ্বানে জান্তা কর্ণপাত করেছে বলে মনে হচ্ছে না। অর্থাৎ জান্তা যে নির্বাচন দিতে চলেছে, তা আন্তর্জাতিক মান পূরণে আদৌ সফল হবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
এক বিবৃতিতে ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘নির্বাচনে পরিকল্পিতভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নিলে তা আরো অস্থিরতা ডেকে আনবে, সহিংসতাকে আরো উসকে দেবে, চলমান সংকটকে দীর্ঘায়িত করবে এবং গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা থেকে মিয়ানমারকে অনেক দূরে ঠেলে দেবে।’ তবে এই কথার পরও জান্তা সরকার পাতানো-জাল নির্বাচনের পথে হাঁটলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। কেননা, ভারতের মতো জান্তা সরকারের দীর্ঘদিনের সমর্থক দেশগুলো গত বছরের এপ্রিলে জান্তা-সমর্থিত নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের প্রতি সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। বলা বাহুল্য, সেই বৈঠকে জান্তাকে কমিশন গঠনের জন্য যে কূটনৈতিক বৈধতা দেওয়া হয়, তাতে জান্তা নেতৃত্বের শক্তি ও মনোবল কিছুটা হলেও বেড়ে গেছে। ঘটনা আছে আরো। যেমন—জাপান মিয়ানমারে দীর্ঘদিনের বিনিয়োগকারী দেশ। বৃহত্তম বিনিয়োগকারী হওয়ায় (৪০০-রও বেশি জাপানি কোম্পানির মিয়ানমারে বিনিয়োগ রয়েছে) জান্তার বিরুদ্ধে জোরেশোরে কথা বলে না জাপান। সামরিক অভ্যুত্থানের আগে মিয়ানমারে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করে বসে জাপানি কোম্পানিগুলো। সম্ভবত জাপানি কোম্পানিগুলোর এই ভয় আছে যে, ‘নির্বাচনের ফলাফল’ এমন কোনো ‘নতুন মোড়’ বয়ে আনতে পারে, যাতে করে দেশটিতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পরিবেশ নাও থাকতে পারে!
২০২২ সালের জানুয়ারিতে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৮০ শতাংশ জাপানি কোম্পানি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারণ বা অন্তত বজায় রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছে। জাপানি কোম্পানিগুলোর নীতিনির্ধারক মহলের মিডিয়া ইন্টারভিউ কিংবা তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষকদের (মধ্যস্থাকারী) কাছ থেকে যেসব বিশ্লেষণ শোনা যায়, তা এই ইঙ্গিত দেয় যে, জাপানি ও অন্যান্য এশিয়ান কোম্পানির মিয়ানমার সংকট নিয়ে সোজাসাপটা কথা হলো—‘অপেক্ষা করুন এবং ধৈর্য সহকারে দেখুন’।
সত্যি বলতে, জাপানের টয়োটা, সুজুকির মতো কোম্পানিগুলো মিয়ানমারে বহাল তবিয়তে ব্যবসা করে যাচ্ছে। কিছু ঘাত-প্রতিঘাত তাদেরকেও মোকাবিলা করতে হয়েছে বা হচ্ছে এ কথা যেমন সত্য, তেমনিভাবে এ কথাও মানতে হবে, কিছু জাপানি সংস্থা মিয়ানমারের মানবাধিকারের সমস্যাগুলো সমাধানের প্রশ্নে এমন সব ‘প্রতিক্রিয়া-প্রতিশ্রুতি’ প্রদর্শন করে, যা পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে মিয়ানমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে প্ররোচিত করে। অর্থাৎ দিনশেষে ‘লাভ’টা ওঠে জাপানের থলিতে।
এই যখন অবস্থা তখন বলতেই হয়, জান্তা সরকারের অধীনে মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ‘একটি খুনি সরকারকে বৈধতা দেওয়ার বৃথা নীলনকশা’ ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না। সুতরাং, মিয়ানমারকে সমর্থন দেওয়া দেশগুলোকে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে, মিয়ানমার শান্ত না হলে বৃহৎ স্বার্থের জন্য তা কী বয়ে আনবে—লাভ, না লোকসান?