মানুষের কখন উত্থান ঘটে কখন পতন হয় তা কেউ বলতে পারে না। কেউ বলে ভাগ্য, কেউ বলে কর্ম মানুষকে ওপরে তোলে এবং নিচে নামায়। কে জানে! এ তো বহুকালের বিতর্কিত বিষয়। তথাপি আমরা কারো উত্থান দেখে, আবার কারো পড়ে যাওয়া দেখে বিস্মিত হই, অবাক হই। যখন খুব সাধারণ অবস্থা থেকে কেউ অতিমাত্রায় ধন সম্পদের মালিক হন, তখন অন্যরা ভাবতে থাকে। কেউ ঈর্ষান্বিত হয়, কেউ উত্সাহিত হয়। তেমনি একজন মানুষের নাম গৌতম আদানি।
সম্প্রতি তিনি শুধু ভারত নয়, বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়েছেন বিনিয়োগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেলবার্গ রিসার্চ এলএলসির একটি রিপোর্টের কারণে। কিন্তু কে এই গৌতম আদানি কী করে উঠে এসে বিশ্বের ৩ নম্বর ধনীতে পরিণত হয়েছেন (এই মুহূর্তে রিপোর্টটি প্রকাশের পর অবশ্য তার শেয়ারবাজার পতনের কারণে তিনি তালিকা থেকে পিছিয়ে পড়েছেন)?
আদানি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬২ সালে ভারতের গুজরাটের একটি জৈন পরিবারে। তার পিতার নাম শান্তিলাল আদানি এবং মা শাতাবেন আদানি। আরো সাত ভাইবোন রয়েছে আদানির। তিনি পড়াশোনায় আগাতে পারেননি। সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া থেকে ইস্তফা দেন। পড়াশোনায় মন বসেনি। তাকে ধরেছিল ব্যবসার নেশায়। পিতা শান্তিলালের একটি ছোট টেক্সটাইল কারখানা ছিল। পিতা চেয়েছিলেন ছেলে তার মতোই টেক্সটাইল ব্যবসা করুক। কিন্তু আদানির তা ভালো লাগেনি। ১৯৭৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে মুম্বাইয়ের মহেন্দ্র বাদ্রার্স ডায়মন্ড কোম্পানিতে কাজ নেন। সেখানেই চলছিল। কিন্তু ১৯৮১ সালে তার ভাই মহাসুখভাই আদানি প্লাস্টিকের ব্যবসা শুরু করেন আহমেদাবাদে এবং গৌতমকে ডাকেন তার সঙ্গে যোগ দিতে। গৌতম তার সঙ্গে যোগ দেন। সেই সূত্রে তারা পলিভিনিল ক্লোরাইড (সংক্ষেপে আমরা যাকে পিভিসি বলি) আমদানি করতে শুরু করেন। এই ব্যবসায় তাদের দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। ১৯৮৫ সালে ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য গৌতম আদানি পলিমার আমদানি শুরু করেন এবং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম দেন আদানি এন্টারপ্রাইজ। কোম্পানি কৃষি এবং বৈদ্যুতিক পণ্য আমদানিতেও যুক্ত হয় এবং আদানি এন্টারপ্রাইজ পরিণত হয় আদানি গ্রুপ-এ। ১৯৯৪ সালে গুজরাট সরকার মুন্দ্রা বন্দরটির ব্যবস্থাপনা কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ১৯৯৫ সালে আদানি গ্রুপ এই বন্দরের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই বছরই বন্দরটিতে প্রথম জেটি স্থাপন করে আদানি গ্রুপ। বর্তমানে এই গ্রুপ সবচেয়ে বৃহৎ প্রাইভেট বন্দর অপারেটর। মুন্দ্রা বন্দর এখন ভারতের ব্যক্তিমালিকানাধীন সবচেয়ে বড় পোর্ট যেখানে বছরে ২১০ মিলিয়ন টনের অধিক মালামাল হ্যান্ডেলিং করতে সক্ষম। সম্প্রতি আদানি ইসরায়েলের হাইফা বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন। তিনি সময়ে সময়ে মেটাল, টেক্সটাইলসহ অনেক ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন।
১৯৯৬ সালে আরো এক দফা সম্প্রসারিত হয় ভাগ্যের রাস্তা, প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আদানি পাওয়ার’। এখন ৪ হাজার ৬২০ মেগাওয়াটের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে আদানি গ্রুপের, যা ভারতের সবচেয়ে বড় প্রাইভেট থার্মাল পাওয়ার। ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে আদানি গ্রুপ অস্ট্রেলিয়ার কুইনসল্যান্ডের কারমাইকেল কয়লা খনি এবং কুইনসল্যান্ডের উত্তরে অ্যাবোট পয়েন্ট আদানি গ্রুপের হাতে আসে। ২০২০ সালে ৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যে ‘সোলার এনার্জি করপোরেশন অব ইনডিয়া’ ডেকে নেন, যা ভারতের সবচেয়ে বড়।
২০২০ সালে আদানি গ্রুপ মুম্বাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ৭৪ শতাংশ অংশীদারিত্ব অর্জন করে। এটি দিল্লির পর ভারতের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর। ২০২১ সালে ব্লুমবার্গ ইনডিয়া ইকোনোমিক ফেরামে বক্তব্য দিতে গিয়ে গৌতম আদানি ঘোষণা দেন যে তার কোম্পানি গ্রিন এনার্জি ব্যবসায় ৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। ২০২২ সালে ভারতের আরেক ধনকুবের মুকেশ আমবানিকে পেছনে ফেলে আদানি এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। এই বছরই ভারতের বিখ্যাত আম্বুজা সিমেন্টও কিনে নেয় আদানি গ্রুপ।
কিন্তু গ্রুপের পথ সর্বদা কণ্টকমুক্ত নয়। ভারতের এস এম সুজ কোম্পানির এক মামলায় ২০০২ সালে গৌতম আদানিকে দিল্লি পুলিশ গ্রেফতার করে। কিন্তু পরের দিনই তাকে ছেড়ে দিতে হয় আপসরফা হওয়ায়। ভারতের এনডিটিভি কেনা নিয়েও একটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। এবার জানুয়ারি মাসে হিনডেনবার্গের রিপোর্টের কারণে রাতারাতি বিশ্বের তৃতীয় ধনীর অবস্থান থেকে নেমে যেতে হয়। শেয়ারবাজারে ৪৫ বিলিয়ন ডলার লোকসানের মুখে পড়তে হয় আদানি গ্রুপকে। অবশ্য আদানি গ্রুপ ঐ রিপোর্টকে নির্লজ্জ এবং সাজানো বলে অভিযোগ করেছে।
ব্যক্তিগত জীবনে আদানি দুই সন্তানের জনক। স্ত্রী দন্ত চিকিৎসক প্রীতি আদানি। ১৯৯৮ সালে আদানি এবং তার সহযোগী শান্তিলাল প্যাটেলকে অপহরণ করে জিম্মি করা হয়েছিল মুক্তিপণের জন্য। কিন্তু কোনো অর্থকড়ি না দিয়েই জিম্মি করাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। অভিযুক্ত গ্যাংস্টার ফজলুর রহমান এবং ভোগিলাল দর্জিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ আদানি এ নিয়ে আর সাক্ষ্য-সাবুতে যাননি। বিশ্বব্যাপী যারা অর্থ সম্পদের মালিক হন তাদের কিছু সামাজিক কাজেও যোগ দিতে দেখা যায়। আদানিও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি গড়ে তুলেছেন আদানি ফাউন্ডেশন। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় আদানি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কেয়ারস ফান্ডে ১০০ কোটি রুপি দান করেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর তহবিলে ৫ কোটি এবং মহরাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর তহবিলে ১ কোটি রুপি দান করেন। ২০০৮ সালে যখন মুম্বাইর তাজমহল হোটেলে সন্ত্রাসী হামলা হয়, তখন আদানি সেই হোটেলেই ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।