আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর শর্ত মেনে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে ১৮ শতাংশ হারে। অথচ বিগত সময়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে গড়ে ১২ শতাংশ হারে। শর্ত অনুযায়ী প্রতি বছর জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে রাজস্ব। এজন্য ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় করতে হবে। ২০২৬ সাল শেষে অতিরিক্ত আদায় করতে হবে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব। বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন কঠিন বলে উল্লেখ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)। উল্লেখ্য, চলতি ২০২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল আইএমএফের শর্তগুলোর বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পিআরআই। ‘ইমপ্লিকেশন অব আইএমএফ লোন কন্ডিশন অন ডমেস্টিক রেভিনিউ মবিলাইজেশন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এবং পিআরআইয়ের স্টাডি সেন্টারের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক।
এক প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে থাকলে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ আমাদের জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায় বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় কম। কর হার বাড়িয়ে এই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়। কারণ দেশের করের যে হার, সেটি উচ্চ মাত্রাতেই রয়েছে। কাজেই কর হার বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব নয়। যেমন ৫ শতাংশ আছে ১০ শতাংশ করে দিলাম, এভাবে হবে না। এজন্য সংস্কার করতে হবে। তিনি বলেন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে কিন্তু সেটা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ সে ধরনের পলিসি সাপোর্ট দেওয়া হয়নি। যে কোনো রিফর্ম করতে গেলে বাধা আসে।
সংস্কারে বাধা কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এনবিআরের পরিবর্তন মাঠ পর্যায় থেকে হতে হবে। ফিল্ড লেভেলে রিফর্মের আলোচনা বহুদিন ধরেই চলছে। আমাদের এখানে রোডম্যাপও করা হয়েছিল কিন্তু সেটা মাঠ পর্যায়ের বাধার কারণে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সংস্কার চান না। তাছাড়া ব্যবসায়ীরাও পরিবর্তন চান না। কারণ ব্যবসায়ীরা একটা কমফোর্ট জোনে আছে। কোনো না কোনোভাবে ম্যানেজ করে তারা চলছেন। নতুন কিছু করাকে তারা ভীতিকর মনে করেন। তাদের অনেকেই বুঝে, না বুঝে সংস্কারের বিরোধিতা করেন। এখানে পলিটিক্যাল ইকোনমি রয়েছে।
ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকার আইএমএফকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ট্যাক্স বাড়ানোর জন্য ২০২৬ সালের মধ্যে ১ কোটি লোককে টিআইএন-এর আওতায় আনার কথা বলছে সরকার। একই সঙ্গে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ৩০ হাজার ইলেকট্রনিকস যন্ত্র দিতে চায়। এর ফলে ১০৫ বিলিয়ন ডলার রেভিনিউ আসবে বলে মনে করছেন সরকার। কিন্তু বর্তমানে জিডিপির হিসাবে রাজস্ব আদায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় কম। আইএমএফ এর ঋণ কর্মসূচি ৪২ মাস পর যখন শেষ হবে তখন এই হার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ করতে হবে। এটা ছোট টার্গেট মনে হতে পারে কিন্তু ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এই হার ১২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। সেজন্য আইএমএফ না বললেও রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর প্রক্রিয়া এ বছরই শুরু করতে হবে। তাছাড়া শর্ত অনুযায়ী ২০২৪ সালের মধ্যে ট্যাক্স কমপ্লায়েন্ট তৈরি করতে হবে। আগামী বছরের মাঝামাঠি রেভিনিউ স্ট্রাটেজি করতে বলা হয়েছে। নতুন কাস্টমস অ্যাক্ট করতে বলা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পলিটিক্যাল ইকোনমির কারণে তদবির বা লবিং করে কর ছাড় সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো সিস্টেম দাঁড় করানো হয় না। রাজস্ব খাতের ক্ষেত্রে আইএমএফের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জের হবে। তবে এটা অসম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, কোনো স্টাডি নেই, তাই আমরা জানি না কোথায় কতটা কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্পকে প্রায় শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে যেটা অন্যদের দেওয়া হয়নি। এজন্য আমরা সংস্কার করতে বলছি। যেমন সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যার হাউজ। এটা করা হলে ছোট বিনিয়োগকারীরাও এখান থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। অথচ এনবিআর এটা করছে না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ২০১২ সালে ভ্যাট আইন সংস্কারের যে উদ্যোগ আইএমএফের পরামর্শে নেওয়া হয়েছিল সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এই ভ্যাট আইন তারা চায়নি। এর ফলে শেষ দিকে দুটি কিস্তি আর দেওয়া হয়নি। ডলার ক্রাইসিস শেষ হয়ে গেলে যদি সরকার মনে করে সংস্কার প্রয়োজন নেই, সেক্ষেত্রে আইএমএফ এর কিস্তিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটা অনেক দেশের ক্ষেত্রেই হতে দেখা যায়। পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দুই বছর আগে তাদের ঋণ অনুমোদন হয়ে আছে। কিন্তু নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আইএমএফ বলেছিল জ্বালানির দাম বাড়াতে। সেটা না করা পর্যন্ত তারা আলোচনায় আর আসেনি। এখন দাম বাড়ানোর পরে আবার আলোচনা শুরু করেছে।