- সিলেটে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে ফায়ারকর্মীদের ছুটি বাতিল
- সিলেটে নিত্যপণ্যের সংকট
অনলাইন রিপোর্টার ॥ দেশের ৬৪ উপজেলায় বন্যার কারণে নাজুক সিলেটের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টার বর্ষণে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পানি ঢুকেছে।
শনিবার (১৮ জুন) দুপুর ১২টার দিকে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে নিচতলার ওয়ার্ডগুলোতে পানি ঢুকতে শুরু করে। হাসপাতালের জেনারেটরে পানি ঢোকায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুত সংযোগ না থাকায় হাসপাতালের অস্ত্রোপচার বিভাগ ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) চিকিৎসাব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটেছে।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ নিচতলায় হাঁটু সমান পানি। একই সঙ্গে হাসপাতালের কেন্দ্রীয় জেনারেটরও পানির নিচে। ফলে হাসপাতালের বিদ্যুত ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ কারণে জরুরি অপারেশন ও আইসিইউ ও সিসিইউর রোগীদের নিয়ে বিপাকে আছি।
নিজের অফিস কক্ষেও হাঁটু সমান পানি জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক আরও বলেন, নিচতলায় সার্জারি, নবজাতক শিশুদের বিশেষায়িত ওয়ার্ড স্কেনো, প্যাথলজি বিভাগ, জরুরি বিভাগ, মেডিসিন বিভাগ, প্রিজন ওয়ার্ড, এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিন কক্ষেও পানি ঢুকেছে। বিদ্যুত না থাকায় হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের প্রায় ১৫০ ব্যাগ রক্ত নষ্ট হওয়ার উপক্রম। ফ্রিজ নিচ থেকে উপরে তোলা হলেও বিদ্যুত না থাকায় রক্তগুলো জমাট বাঁধতে শুরু করছে।
মাহবুবুর রহমান বলেন, সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও হাসপাতালের সার্ভার লাইন পানির নিচে থাকায় বিদ্যুত চালু করা যাচ্ছে না। তাই বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটি ছোট ছোট জেনারেটর দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানিয়েছি।এদিকে, সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মানবিক সাহায্যে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। শুক্রবার (১৭ জুন) সকাল থেকে সিলেট বিভাগীয় অফিস সাহায্য কার্যক্রম জোরদার করেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় খোলা হয়েছে বন্যায় উদ্ধার কাজের মনিটরিং সেল। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেটের সব স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে স্ট্যান্ডবাই ডিউটিতে মোতায়েন রাখা হয়েছে।
সিলেটের এই ভয়াবহ বন্যায় মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। তাদের নেতৃত্বে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও। গতকাল শুক্রবার থেকে বিপর্যয়ের মুখে থাকা সিলেট সদরের খাদ্য গুদামে ঢুকে পড়া পানি নিয়মিতভাবে পাম্পের মাধ্যমে সরানোর কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট।
এছাড়া বিপর্যয়ের মুখে থাকা কুমারগাঁও বিদ্যুত কেন্দ্রেও নিয়োজিত করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট। সেখানেও তারা ভেতরে ঢুকে পড়া পানি নিয়মিতভাবে সরানোর মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ স্বাভাবিক ও চলমান রাখার কাজে সহায়তা করছে।
ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশনায় গতকাল (শুক্রবার) রাতেই জরুরি ভিত্তিতে অধিদফতর থেকে সিলেটে জেমিনি বোট পাঠানো হয়েছে। জেমিনি বোটের সাহায্যে শনিবার (১৮ জুন) সকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে খাদ্য সাহায্য পৌঁছে দিতেও কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ফায়ার সার্ভিস হচ্ছে মানুষের দুঃসময়ের বন্ধু। সিলেটের এই মানবিক বিপর্যয়ে আমাদের সদস্যরা ঘরে বসে থাকতে পারেন না। আমরা রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা সিলেটের বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে আছি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই সময় ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের সব কার্যক্রম নিয়মিত ও নিবিড়ভাবে আমি নিজেও পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজনীয় সব সাহায্য নিয়ে এই দুর্যোগে সিলেটবাসীর পাশে থাকবে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
অন্যদিকে, টানা বৃষ্টি ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে দোকানপাট তলিয়ে যাওয়ায় সিলেটে নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বেশি দামেও মিলছে না চাল-ডালসহ নিত্যপণ্য। এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ থাকায় দেখা দিয়েছে মোমবাতি ও দেশলাই সংকট। বন্যার পানিতে বহু দোকান তলিয়ে যাওয়ায় এ সংকট দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বন্যায় বেশিরভাগ দোকান খুলছেন না দোকানিরা। এছাড়াও অসংখ্য দোকান পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে করে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। ৩৮ টাকা হালির ডিমের দাম বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছে। ২০ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। দোকানে দোকানে ঘুরেও এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
শহরের মদিনা মার্কেটের এক দোকান মালিক বলেন, বৃষ্টি ও বন্যার কারণে সকালে দোকান খুলিনি। দুপুরে বৃষ্টির পরিমাণ কমলে দোকান খোলা মাত্র ক্রেতারা লাইন দিয়ে নিত্যপণ্য ক্রয় করা শুরু করেন।
বাগবাড়ি এলাকার গাড়িচালক রাহাত আহমদ জানান, দুপুরে মদিনা মার্কেট ও বাগবাড়ি রোডের অন্তত ১৫-২০টি দোকানে খুঁজেও আলু ও সয়াবিন তেল পাইনি। পরে একটি দোকান থেকে দুই কেজি আলু ৬০ টাকায় কিনেছি।
রিকাবীবাজার এলাকার আল মক্কা স্টোরের মালিক মো. জসিম আহমদ বলেন, মোমবাতি ও দেশলাইয়ের চাহিদা বেড়েছে। অনেকে দুই থেকে তিন প্যাকেট করে মোমবাতি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে সংকট তৈরি হচ্ছে।
এদিকে, শনিবার সকাল থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে সিলেট নগরের অনেক এলাকায় নতুন করে পানি প্রবেশ করেছে। নগরীর মদীনা মার্কেট, বাগবাড়ি, সুবিদবাজার, কলাপাড়া, আম্বরখানা, চৌহাট্টাসহ অনেক উঁচু এলাকা আজ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্রবল স্রোতসহ পানি প্রবেশ করতে থাকায় এসব এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল এক ১০৮.৭ মিলিমিটার। সেখানে আজ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ১৫৭ মিলিমিটার। এর মধ্যে সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ছিল ৪৭ মিলিমিটার এবং সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছিল ১১০ মিলিমিটার। আজ আরও বৃষ্টি হবে এবং এ অবস্থা আরও ২-৩ দিন অব্যাহত থাকবে।
।