আষাঢ়ের তৃতীয় দিন গতকাল শুক্রবার ভারী বর্ষণ হয়েছে নগরে। সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সৃষ্ট এ বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় নিচু এলাকা। জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন নগরবাসী। গোড়ালি থেকে হাঁটু সমান পানি জমে যায় সড়কে। অনেক এলাকার বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে যায়। গত রাত ১২ টায় এ রিপোর্ট লেখার সময়েও আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা ও দুই নম্বর গেটসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কে কোমর সমান পানি ছিল বলে স্থানীয় লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন। বহদ্দার হাট মোড়, মুরাদপুর ও দুই নম্বর গেট এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে গাড়ির জটলা বেধে যায়। রাতে আখতারুজ্জামান বাবু ফ্লাইওভারে উপর বহদ্দারহাট থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা যায়।
সব মিলিয়ে গতকাল দিনভর চিরচেনা জলাবদ্ধতাজনিত দুর্ভোগের মুখোমুখি ছিল পানিবন্দী লোকজন। এ ছাড়া সকালে আগ্রাবাদ মা শিশু হাসপাতালের পুরাতন ভবনের নিচ তলায় গোড়ালির বেশি উঠে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। এ দিকে বৃষ্টি ও জলযটের অজুহাতে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করেছে সিএনজি ও রিকশা চালকরা। এদিকে ভারী বৃষ্টিতে ধসের শঙ্কায় নগরের বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করে নির্দেশনা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের স্টাফ অফিসার শ্রাবণ কুমার জানান, নগরীতে ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট মাইকিং করছেন। এতে কিছু পরিবার স্বউদ্যোগে সরে গেছে। আরো কিছু পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। হাটহাজারী ও সীতাকুণ্ডেও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে মাইকিং করার খবর পাওয়া গেছে।
এ দিকে বৃষ্টির সময়ে বিভিন্ন খাল-নালা থেকে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করেছে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনটি ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম। যেখানে যেখানে পানি আটকে গিয়েছিল সেখানে পরিষ্কার করে দেন তারা। বিষয়টি নিশ্চিত করে নগরে চলমান জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী দৈনিক আজাদী বলেন, খালে বাঁধ না থাকায় কোথাও পানি আটকাচ্ছে না। তবে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় পানি যেতে সময় লাগছে। দুই নম্বর গেট ও মুরাদপুর এলাকার জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরো খালের কাজ তো এখনো শেষ হয়নি। খাল বড় করলেও মুরাদপুরে তো কালভার্ট করা হয়নি। সেখানে তিন ফুট জায়গা দিয়েই পানি যাচ্ছে। ফলে এদিকে পানি আটকে আছে।
৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড : বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল শুক্রবার দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর প্রায় এক ঘণ্টা একটানা বৃষ্টি হয়েছে। এরপর থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। মাঝখানে কিছুক্ষণ বন্ধ থাকলেও রাত ১০টার দিকে আবারও বর্ষণ শুরু হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পতেঙ্গা অফিসের কন্ট্রোল রুম থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী- গত রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ দশমিক ০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা সন্ধ্যা ৬টায় ছিল ৩৯ দশমিক ০৮ মিলিমিটার এবং বিকেল তিনটায় ছিল ৪০ দশমিক ৮ মিলিমিটার।
ভারী বর্ষণ হতে পারে আজও : আজ শনিবারও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও প্রবল বজ্রপাতসহ ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (৮৯ মিলিমিটার বা তার অধিক) বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কবাণীতে বলা হয়।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ ও পূর্বাভাস কর্মকর্তা শেখ হারুন-অর-রশীদ জানান, আজ শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় আকাশ মেঘলা থেকে সাময়িকভাবে মেঘাচ্ছন্ন থাকতে পারে। সে সাথে অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা বাতাসের সাথে হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। দক্ষিণ অথবা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ১২-১৮ কিলোমিটার বেগে যা অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়া আকারে ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে।
রাতেও পানিবন্দী ছিল লোকজন : গত রাত ১০টার দিকে বহাদ্দারহাট-মুরাদপুর পর্যন্ত প্রধান সড়কে পানি থাকার কথা দৈনিক আজাদীকে জানান কাদের হোসাইন নামে এক পথচারী। এ ছাড়া জিইসি মোড়, ওয়াসা, শুলকবহর, চকবাজারসহ আশেপাশের এলাকায়ও গত রাত ১০টার দিকে হাঁটু সমান পানি ছিল। একই সময়ে দুই নম্বর গেটও তলিয়ে যায় পানিতে। এ ছাড়া রাত ৮টার দিকে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকায়ও তীব্র জলযট ছিল বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী আলিউর রহমান।
দিনেরও চিত্রও অভিন্ন : দিনের বৃষ্টিতে চকবাজার মুহাম্মদ আলী শাহ দরগাহ লেনে হাঁটু পানিতে দুর্ভোগে পড়েন স্থানীয়রা। সেখানে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতেও পানি ঢুকে যায়। পাশেই আবদুল হাকিম সওদাগর লেনও হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায় বলে করিম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান।
এ ছাড়া দিনভর সরেজমিন পরিদর্শন ও স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, ওয়াসা, জিইসি, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, দক্ষিণ কাট্টলী, চকবাজার, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, বাকলিয়াসহ বিভিন্ন নিচু এলাকায় হাঁটু সমান পানি জমে যায়।
এছাড়া দুপুরে বাকলিয়ার কে বি আমান আলী রোড ফুলতলা, বড় মিয়া মসজিদ, ডিসি রোড, নুর বেগম মসজিদ এলাকাসহ আশপাশের এলাকা পানিতে তলিয়ে ছিল। ওয়াসা, জিইসি মোড়, হালিশহর, ঈদগাঁহ কাঁচা রাস্তা, মনসুরাবাদ পাসর্পোট অফিসের সামনে, দক্ষিণ কাট্টলীর নাথপাড়া, জেলেপাড়া, হরিমন্দির রোড, ছদু চৌধুরী রোডেও জলযটে দুর্ভোগ ছিল স্থানীয়দের।
আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে পানি : গতকাল সকালে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের নিচতলায় গোঁড়ালির বেশি পানি দেখা গেছে। তবে এতে রোগীদের তেমন ভোগান্তি হয়নি। কারণ হাসপাতালটির পুরাতন ভবনের নিচ তলার চিকিৎসা কার্যক্রম নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। হাসপাতালে আসা-যাওয়ার সময় রোগী ও তাদের স্বজনদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কারণ হাসপাতালের আশেপাশের সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। শাওন নামে রোগীর এক স্বজন জানান, আমার ছেলে ভর্তি আছে। জরুরি কাজে আমাকে বাইরে যেতে হয়। নিচ তলার পানি ও রাস্তার পানির জন্য ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
দুর্ভোগ ও ভোগান্তি : মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা শহীদ নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, দিনভর বৃষ্টি ও পানির জন্য বাসা থেকে বের হইনি। সন্ধ্যার পর জরুরি প্রয়োজনে বহদ্দারহাট যেতে হয়। রাস্তায় এসে দেখি প্রায় হাঁটু সমান পানি। লোকাল গাড়িও কম ছিল। বাধ্য হয়ে রিকশা নিই। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও দ্বিগুণ ভাড়া গুণতে হয়েছে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে দুই নম্বর গেট এলাকায় পথচারী হাসান জানান, পানি আর পানি। যাওয়ার পথ নাই। গাড়িও কমে গেছে। রিকশা ভাড়া তিন-চার গুণ বেশি দাবি করছে।