রূপকল্প ২০৪১-এর সমন্বিত পরিকল্পনার জন্য ২০১৫ সালের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দেন। মূলত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়নে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে রূপকল্প ২০৪১-এর কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এই রূপকল্প ২০৪১-এর দুটি মূল দর্শন রয়েছে। তার একটি হলো ২০৪১ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করা। রূপকল্প ২০৪১-এর এই গুরুত্বপূর্ণ দুটি দর্শন বাস্তবায়নে কয়েকটি কৌশলগত লক্ষ্য এবং বেশকিছু কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শনের আলোকে রূপকল্প ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের রোডম্যাপ নির্ধারণ করেন ২০০৯ সালে সরকার গঠনের এক বছরের মাথায়। এটিকে দিনবদলের সনদ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। মূলত এই সময়েই ডিজিটাল বাংলাদেশের বিষয়টি জোরেশোরে উল্লিখিত হয়। এ সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রচলন ও প্রয়োগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। এ দেশে যখন ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রচলনের বিষয়ে বলা হচ্ছিল তখন অনেকেই এ বিষয়টি নিয়ে উপহাস করেছে, বলেছে যেদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ চাহিদার তুলনায় কম, সে দেশে ডিজিটাল ব্যবস্থা বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব! কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ খাতেই ডিজিটাল সেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়েছে, যার সুফল ভোগ করছে জনগণ। আর এটি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন হয়েছে করোনাকালীন। শুরুতে ডিজিটাল ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে অনেক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে হয়েছে। যার একটি পর্যাপ্ত ও নিয়মিত বিদ্যুত সরবরাহ এবং প্রাপ্যতা। এছাড়াও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ সংশ্লিষ্ট নানাকিছুর অভাবও পরিলক্ষিত। এমনকি ডিজিটাল সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রেও নানা উদাসীনতা দেখা গিয়েছিল। কারণ জনগণ ডিজিটাল ব্যবস্থার সুফল সম্পর্কে অবহিত ছিল না। কিন্তু পর্যায়ক্রমে দেশে ডিজিটাল ব্যবস্থায় সেবা সম্প্রসারণের ফলে এই ব্যবস্থার সুফল ও সেবা প্রাপ্তি জনগণকে আগ্রহী করে তোলে। যা সম্ভব হয়েছে দূরদর্শী নেতৃত্বের সমন্বিত উদ্যোগের কারণে। মূলত ২০০৯ সালের পর থেকে রূপকল্প ২০২১-এর রোডম্যাপ বাস্তবায়নে অনেকগুলো সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার কারণে এর সুফল জনগণ পেতে থাকে। বর্তমানে এই ডিজিটাল ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে রূপকল্প ২০২১-এর থেকে রূপান্তর হয় রূপকল্প ২০৪১। প্রসঙ্গত, রূপকল্প ২০২১-এর রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। আর তা বাস্তবায়নে দেশের ষষ্ঠ এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে দেশ অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নানা কর্মসূচি-কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। এই বাস্তবতায় বলা যায় যে, রূপকল্প ২০২১-এর সব লক্ষ্য ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে। আর সেজন্য রূপকল্প ২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন পায়। ছয়টি মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। যা হলো, করোনা মহামারি থেকে দ্রুত পুনরুদ্ধার, সহস্রাব্দ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, বিস্তৃত অন্তর্ভুক্তির কৌশল, টেকসই উন্নয়নের পথপরিক্রমা, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন ঘটিয়ে অর্থনীতিকে ২০৩১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়া, দরিদ্রতা হ্রাস ও কর্মসৃজনের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ-পরবর্তী অভিঘাতের প্রভাব নিরসন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সফলতার ওপর দাঁড়িয়ে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রূপকল্প ২০২১ সব লক্ষ্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সময়কালে অর্জিত হয়েছে। সুতরাং এখন বলা যায়, ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রচলন ও সাফল্যের পর বর্তমান বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে স্মার্ট বাংলাদেশের নির্মাণ শুধু তথ্য ও প্রযুক্তিগত খাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সব খাতের অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়িত হবে। রূপকল্প ২০৪১-এ এই বিষয়টি সুস্পষ্ট। আগেই উল্লেখ করেছিলাম, রূপকল্প ২০৪১-এ কিছু কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে বেশকিছু কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। রূপকল্প ২০৪১-এর নির্দিষ্ট কৌশলগত লক্ষ্য হলো : (১) ২০৩১ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল আর ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার তিন ভাগে নামিয়ে আনা। (২) ২০৩১ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, ২০৪১ সালে উচ্চআয়ের দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা। (৩) কৃষিতে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। (৪) সেবা খাতকে গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরের সেতু হিসেবে গড়ে তোলা। (৫) নগর সুবিধায় ব্যাপক পরিবর্তনের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরের কৌশল গ্রহণ। (৬) দ্রুত ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সুচারুরূপে জ্বালানি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা। (৭) জলবায়ু অভিঘাত ও অন্যান্য পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ থেকে সুরক্ষা পেতে যথাযথ কৌশল প্রণয়ন। (৮) দক্ষতাভিত্তিক সমাজগঠনে বাংলাদেশকে জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা (সূত্র : উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ, পৃ. ১৫৩)। উল্লিখিত কৌশলগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায় খাতভিত্তিক উন্নয়ন ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি কৌশলই যথাযথ ও গুরুত্ববহ, যা স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে প্রতীয়মান হয়। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উল্লিখিত কৌশলগত লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সরকার থেকে বেশকিছু বিষয়ের ওপর কর্মপরিকল্পনা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। যেমন :অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, দারিদ্র্য ও আয়ের অসমতা হ্রাস, গুণগত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মানব উন্নয়ন এবং জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ ইতিবাচকভাবে ব্যবহার, টেকসই কৃষিব্যবস্থা, খাদ্যনিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়ন রূপকল্প, টেকসই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, শিল্পায়ন রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও আসন্ন বৈশ্বিক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবনার আলোকে কর্মসৃষ্টির পরিকল্পনা, আইসিটি খাতকে যথাযথভাবে বৈশ্বিক অগ্রগতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা উপযোগী করে তুলতে উদ্ভাবনী অর্থনীতির ভিত গড়ে তোলা, টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ, একটি উচ্চ আয়ের অর্থনীতির পথে নগর রূপান্তরের ব্যবস্থাপনা, একটি গতিশীল বদ্বীপে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে টেকসই পরিবেশের উপস্থিতি এবং সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে অবারিত করা (সূত্র :উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ, পৃ. ১৫৪-১৬৩)। এই কর্মপরিকল্পনা ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিটি বিষয়েরই বিস্তারিত উদ্যোগ গ্রহণকল্পে সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক নির্দেশনা রয়েছে, যা রূপকল্প ২০৪১-এর যথাযথ বাস্তবায়নে সহায়ক ও গুরুত্ববহ। আর তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রূপকল্প ২০৪১-এর সফল বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ স্মার্ট বাংলাদেশ।
অতএব বর্তমান বাংলাদেশের প্রতিটি খাতের অগ্রগতি ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখার বিষয়টি এখন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত। কেননা ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে এই উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। রূপকল্প ২০২১-এর সফলতাকে রূপান্তরের লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১ পৌঁছানো এবং সফলতা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটানো দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচায়ক। তেমনি ২০৩০ সালে এসডিজি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ২০৩১-এ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ধাপটিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও পরিকল্পনা এখন বাস্তব। আর এই বাস্তবতার আলোকে আশাবাদী করে তুলে রূপকল্প ২০২১-এর সফল বাস্তবায়ন ও অভিজ্ঞতা। সবশেষে এ কথা বলতে অত্যুক্তি হবে না যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের ওপর দাঁড়িয়ে বর্তমান বাংলাদেশ ২০৩০ এসডিজি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ২০৩১-এ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং রূপকল্প ২০৪১-এর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এই দেশ অবশ্যই স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। আর এই আশাবাদের সঙ্গে যুক্ত হবে সেই দূরদর্শী নেতৃত্ব, যার পুরোধা হিসেবে রয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, যিনি তার উন্নয়ন দর্শনের আলোকে এই বাংলাদেশ ও এ দেশের আগামী প্রজন্মকে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে বাংলাদেশের জন্য বদ্বীপ পরিকল্পনা তথা ডেলটাপ্ল্যান ২১০০ তৈরি করেছেন।