সুন্দরবন সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই এখন আর। এই বন দুই বাংলার জন্য গর্বের একটি ধন, সে কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না। দুই বাংলাব্যাপী সুন্দবনের বিস্তৃতি মোট ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। বিশাল আয়তনের এই বন ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এই দুর্গম অরণ্য যুগযুগ ধরে মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর জঙ্গল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর রোমাঞ্চকর বলেই হয়তো এই জঙ্গলের গুরুত্ব অপরিসীম পর্যটকদের কাছে। সুন্দরবন থেকে প্রাপ্তিও বিরাট অঙ্কের। ২০১৭ সালের এক গবেষণার তথ্য মোতাবেক জানা যায়, সুন্দরবনের বাৎসরিক আয় প্রায় ৫৮৫৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে বন বিভাগের এক গবেষণায় জানা যায়, সুন্দরবন বছরে প্রায় ১৬ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ধরে রাখতে সক্ষম, যার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ৫-৬ বিলিয়ন ডলার। বিষয়টি কাল্পনিক বা বানোয়াট কোনো গালগল্প নয়; গবেষকদের দীর্ঘদিনের গবেষণালব্ধ ফল এটি।
সমীক্ষায় জানা যায়, পেশাজীবীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ জ্বালানি কাঠ, ৬.৩ শতাংশ মধু ও মোম, ৯.৪ শতাংশ গোলপাতা, ৫৪.৮ শতাংশ মাছ. ১৮ শতাংশ চিংড়ি, ২৯ শতাংশ কাঁকড়া সংগ্রহের মাধ্যমে বছরে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব আদায় হয়। এতে করে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এত সব প্রাপ্তির পরেও সুন্দবনের ওপর বিষফোড়ার আবির্ভাব থেমে থাকেনি। বিশেষ করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে বেশি। বারবার জাহাজডুবির কারণে নদ-নদীর জল যেমন দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। অর্থাৎ, ইকোসিস্টেমে বা বাস্তুতন্ত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি গত ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে ‘এমভি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামক একটি কার্গো জাহাজ ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে ডুবে যেতে। যার ফলে ট্যাংকার গলে জ্বালানি তেল বেরিয়ে আসতে থাকে এবং জোয়ারের কারণে খুব দ্রুত সুন্দরবন অঞ্চলের নদীর ওপর তেলের স্তর ছড়িয়ে পড়ে, যার কারণে জলের নিচে স্বাভাবিক অক্সিজেন প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। এতে করে মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ, শামুক, ঝিনুক এবং বিপন্ন প্রজাতির ইরাবতী ডলফিন হুমকির মুখে পড়ে। এছাড়া হুমকির মুখে পড়ে ৩৭৫ প্রজাতির বন্য ও জলজ প্রাণী। এদের মধ্যে ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। কয়েক প্রজাতির জলজ প্রাণীর মৃত্যুর খবরও আমরা তখন জানতে পেরেছি। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, শূকরসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর জন্য অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। জল পান করতে এসে বন্যপ্রাণীরা জ্বালানি তেল পান করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। শুধু বন্যপ্রাণী কিংবা জলজ প্রাণীরাই নয়, সুন্দরবনের শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদের জন্যও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তেলের আস্তর জোয়ারের সময় মাটির ওপরে বিস্তৃত হয়ে গাছের শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধাগ্রস্ত হয়ে গাছের শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে।
আশ্চর্য হলেও সত্যি, সুন্দরবনাঞ্চলে জাহাজডুবির ঘটনা ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বার ঘটেছে। যদিও সেগুলো তেলবাহী জাহাজ নয়, সেগুলো ছিল সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকারবাহী কার্গো জাহাজ। জাহাজ দুটি ডুবেছে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের হাড়বাড়িয়া ও জয়মণির ঘোল এলাকায়। ১৯ মার্চ ২০১৬ সালে শ্যালা নদীতে ‘সি হর্স-১’ নামের কয়লাভর্তি একটি নৌযানের তলা ফেটে নদীতে কয়লা ছড়িয়ে পড়েছে। জানা গেছে, প্রায় ১ হাজার ২৩৫ মেট্রিক টন কয়লা ছিল সেই কার্গোতে, যা জলে মিশে নদীর জলকে বিবর্ণ করে দেয় তাত্ক্ষণিকভাবে। দূষণের ফলে ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষিত শ্যালা নদীর ডলফিনগুলো উধাও হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ডলফিনগুলো নদী থেকে গভীর সমুদ্রে আশ্রয় নিয়েছে। বিষয়টি গোচরীভূত হলে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের রি-অ্যাকটিভ মনিটরিং মিশনের প্রতিনিধিদল তখন দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে সুন্দরবনে পৌঁছেছে পর্যন্ত। পর্যবেক্ষণ শেষে প্রতিনিধিদল ভীষণ মর্মাহত হয়েছিল।
অন্যদিকে ১৪ এপ্রিল, ২০১৮ সালে ‘এমভি বিলাস’ নামের একটি লাইটার কার্গো জাহাজ পশুর নদের হাড়বাড়িয়া এলাকায় ৭৭৫ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ডুবে গেছে। মাসখানেক আগে অর্থাৎ ১৭ মার্চ মোংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের রামপাল খেয়াঘাট এলাকায় ‘এমডি মদিনা মুনওয়ার’ নামের একটি জাহাজ ২ হাজার ব্যাগ সিমেন্ট নিয়ে ডুবে গেছে। জাহাজগুলোর তেল-মবিল জলের সঙ্গে মিশে পরিবেশের যেমন বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, তেমনি ডুবে যাওয়া সিমেন্ট এবং কয়লায় সালফারের পরিমাণ বেশি থাকায় মারাত্মকভাবে ক্ষতি করছে।
গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ সালে ‘শাহজালাল এক্সপ্রেস’ নামক একটি লাইটার জাহাজ মোংলা বন্দরের পশুর নদে ডুবে যায় ৫০০ টন সার নিয়ে। জাহাজটা ডুবে যাওয়ার ১১ দিন পর উদ্ধারকারী দল তল্লাশি চালিয়ে জানাল, জাহাজের খোলসে থাকা সার নদীর পানিতে মিশে গেছে, অবশিষ্ট নেই একটুও।
ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে পরিবেশবিদেরা হইচই করেছেন ব্যাপক এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের বৃহত্ ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ভেতরে প্রবাহিত নদ-নদীর ওপর দিয়ে নৌপথ বন্ধের দাবিও জানিয়ে এসেছেন তারা। সুন্দরবনের পরিবেশ ঝুঁকিতে জাতিসংঘের জলাভূমিবিষয়ক সংস্থা ‘রামসা’ এবং উন্নয়ন সহযোগী ইউএনডিপিসহ বিশ্বের অনেক নামিদামি পরিবেশবাদী সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পর্যন্ত। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শ্যালা নদীতে যান্ত্রিক নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি, বরং সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত অন্য সব নদ-নদী অনিরাপদে রয়েছে।