একটি সময় ছিল, যখন এলাকায় কোনো একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলে তাকে সবাই দেখতে আসত। সংবাদপত্র, টেলিভিশনের সাংবাদিকরা আসত সাক্ষাৎকার নিতে। কীভাবে সে পড়ল, এত ভালো ফলাফল করার অনুপ্রেরণা—আরো বিভিন্ন প্রশ্ন করা হতো কৃতী শিক্ষার্থীকে। পত্রিকা ও টেলিভিশনে বড় করে জিপিএ-৫ ধারীর ছবিও ছাপা হতো। কালের বিবর্তনে সেই চিত্র আজ আর দেখা যায় না! বর্তমানে জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা লাখ লাখ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, এমন অনেক জিপিএ-৫ ধারী রয়েছে, যারা জিপিএ-এর পূর্ণরূপ পর্যন্ত জানে না! কী সাংঘাতিক! এই ক্ষেত্রে বলতে হয়, বাস্তব জীবনে এই জিপিএ-৫-এর কী আদৌ কোনো মূল্য আছে?
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষা ফল। রেকর্ড পাশের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ায় আনন্দ-উল্লাসে ভাসছেন শিক্ষার্থীরা। তবে তাদের আকাশে চিন্তার মেঘও জমতে শুরু করেছে। কেননা কিছুদিন পরই শুরু হবে ভর্তিযুদ্ধ। আর এতে জিপিএ-৫ পেয়েও অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এবারের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৩৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন রয়েছে ৩৯ হাজারের বেশি। আর এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার শিক্ষার্থী। ফলে জিপিএ-৫ পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন না ১ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী। তাছাড়া প্রতিবছর পরীক্ষায় পাশ করে প্রায় ১০-১২ লাখ শিক্ষার্থী। কিন্তু, পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে আসন রয়েছে ৪ লাখের কিছুটা বেশি। ফলে এ ক্ষেত্রেও বঞ্চিত হবে শিক্ষার্থীরা। এই তথ্য তো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কপালে চিন্তার রেখা এঁকে দেওয়ার মতো!
ঘটনা আছে অন্যখানেও! প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করার পর এই তরুণরা যখন চাকরির বাজারে যায়, তখন তারা বুঝতে পারে, এই জিপিএ-৫ এর বাস্তবিক মূল্য কী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায়, স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার। ঐ প্রতিষ্ঠানের মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান এবং মাত্র ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু একটা (কোনো একটা কাজ বা যে কোনো পেশা) করছেন। বিশ্বব্যাংকও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ করেছিল। তাতেও দেখা গেছে একই চিত্র। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার বলে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। এই গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারত্বের হার বেশি—৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। অন্যদিকে দেশে প্রতি বছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছেন ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান তো হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছেন। এতো মহাবিপদের কথা!
সত্যি বলতে দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের হার যেমন বাড়ছে, তেমন উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান তালে। লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীর কাছে চাকরি হয়ে উঠেছে ‘সোনার হরিণ’। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানত শিক্ষার নিম্নমানই এর জন্য দায়ী। মানহীনতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষা দিতে না পারা ও শিক্ষায় কম বিনিয়োগ ইত্যাদি এর জন্য দায়ী। সব মিলিয়ে শিক্ষিত জনশক্তির জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বর্তমানকালে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুতরাং, এখনই সময় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যুগোপযোগী চিন্তা করা। অর্থাৎ পাশ কিংবা জিপিএ মুখ্য নয়, বরং প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে পারে, সেটি নিশ্চিত করাই আমাদের বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত। পাশাপাশি সর্বক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে হাতে হাতে। সেই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো সৃজনশীল করতে হবে। সর্বোপরি, জীবনকে গড়তে শিক্ষার বিকল্প নেই; কিন্তু সেই শিক্ষা যেন হয় সুশিক্ষা তথা আলোকময় শিক্ষা। আমরা যেন সেই শিক্ষা অর্জন করার পরেই কেবল গর্বের সুরে বলি—‘আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি।’