ভূমিকম্প যে কতটা প্রলয়ংকরী হয়ে উঠতে পারে, তা আবারও দেখল বিশ্বের মানুষ। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, তা-ও প্রত্যক্ষ করল বিশেষজ্ঞ মহল। বলা হচ্ছে সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়ায় সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা। এই ভূমিকম্পের পর সংশ্লিষ্ট এলাকায় যে চরম মানবিক দুর্যোগ নেমে আসে, তাতে করে আবারও সামনে এলো এই বাস্তবতা—দুর্যোগ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, প্রচেষ্টা শুধু প্রয়োজনই নয়, অতি জরুরি। একই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হলো, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে সম্পর্কের উন্নয়নে ‘সাহসী-আন্তরিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তথা কূটনীতি’ রাখতে পারে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা।
তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পের পর আমরা দেখেছি বিশ্বের দেশগুলো অতি দ্রুত দৃর্যোগকবলিত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দুর্যোগকবলিত দেশের প্রতি বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, রাজনৈতিক মতপার্থক্য কিংবা বিরাজমান উত্তেজনাকে এক পাশে রেখে সাহায্যের হাত প্রসারিত করার এই দৃশ্য সত্যিই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। কূটনীতির প্রকৃত সৌন্দর্য মূলত এটাই। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাকর্মী, সেনা, উদ্ধারকারী ডগ স্কোয়াড ও বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে। বহু দেশের পণ্য-সরঞ্জাম পৌঁছানোর পথে। দুর্যোগের শিকার মানুষকে প্রচণ্ড ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা করতে অবলীলায় নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে দিচ্ছেন স্থানীয় নাগরিকেরা। দুর্যোগকালে এ ধরনের সাহায্য-সহমর্মিতা আমাদের আশার আলো দেখায়—এ কথা বলাই বাহুল্য।
ইউরোপীয় কমিশনের ‘ইউরোপীয়ান সিভিল প্রটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিট্রিয়ান এইড অপারেশনস’-এর তথ্য অনুসারে, ২০টি ইইউ দেশ সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে। এসব দেশের ২৯টি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল এবং পাঁচটি মেডিকেল টিম দৃর্যোগকবলিত এলাকায় কাজ করার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। এই সংবাদ তুরস্কের জন্য তো বটেই, সমগ্র বিশ্বের জন্যই স্বস্তিদায়ক। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ে ইইউ ও তুরস্কের মধ্যে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। এই উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সুইডেনের ন্যাটোভুক্তির প্রশ্নে। সুইডেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ঘোর বিরোধী ন্যাটোভুক্ত তুরস্ক। তুরস্কের ঘরের শত্রু কুর্দি গোষ্ঠী কে সুইডেন সমর্থন দেয় বলে অভিযোগ করে আসছে তুরস্ক সরকার। এজন্য দেশটি কোনোভাবেই চায় না ন্যাটো সুইডেনের সদস্যপদের আবেদনপত্র গ্রহণ করুক। কিন্তু তুরস্কের এই মনোভাব সত্ত্বেও ভূমিকম্পের পরপরই দেশটির মানুষকে সাহায্য করতে ছুটে গেছে সুইডেন। সত্যি বলতে, এ ঘটনা বিশেষ করে তুরস্ক ও সুইডেনের আগামী দিনের কূটনীতির জন্য ইতবাচক ফল বয়ে আনবে। বার ইলান ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেরাল্ড স্টেইনবার্গও বলছেন একই কথা। স্টেইনবার্গ মনে করেন, ‘এ ঘটনা দেশ দুটির বৈদেশিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই সুইডেন ও তুরস্কের মধ্যে ন্যাটো অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে দীর্ঘকালের বিরোধ মিটমাট হওয়ার খবর শোনা গেলে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ১৫০ জনের বেশি কর্মী ও ১ লাখ ৭০ হাজার পাউন্ড সরঞ্জাম নিয়ে বুধবার তুরস্কে পৌঁছায় ‘ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট আরবান সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিম’-এর দুটি দল। সিরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ উত্তেজনাপূর্ণ, কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটিকে সাহায্যের কথা জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, ‘এই কঠিন বিপর্যয় থেকে সিরীয় জনগণকে পুনরুদ্ধার করতে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, সুইডেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের উল্লিখিত উদ্যোগ ও প্রতিক্রিয়ার পর এটা নতুন করে প্রমাণিত হলো। তুরস্ক ও সিরিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশ ছুটে গেছে দেশ দুটির সরকারকে সাহায্য করতে। এতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যকার বিভিন্ন বিরাজমান সংকট ও অচলাবস্থার যবনিকাপতন দেখছেন অনেকে। তবে দেখার বিষয়, বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার পর কী ঘটে। এই ‘সাময়িক সুসম্পর্ক’ কতটা স্থায়ী হয়। নতুন কোনো স্থায়ী মাত্রা যোগ হয়, চলমান সমস্যাসমূহ সমাধানে কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো যায়, নাকি পরিস্থিতি আবার আগের চেহারায় ফেরে?
জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ড. ইয়োনাটান ফ্রিম্যানের মতে, ‘এ ধরনের ঘটনায় দেশের আপামর জনগোষ্ঠী সরকারকে প্রভাবিত করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া বাড়ে। এতে করে ইতিবাচক ফল আসার সম্ভাবনাই বেশি।’
উল্লেখ করা দরকার, ১৯৯৯ সালে ভূমিকম্পের পর তুরস্ক ও গ্রিস উভয় দেশের জন্যই ‘ভূমিকম্প কূটনীতি’ সুফল বয়ে আনে। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের বেশ উন্নতি হতে দেখা যায়। নতুন করে দেশটি বিবাদে জড়িয়ে পড়ার আগে এই ইতিবাচক পরিবেশ কয়েক বছর ধরে চলমান ছিল। এবারের ভূমিকম্পের পর তুরস্কে গ্রিসের চিকিৎসা সরঞ্জাম, ডগ স্কোয়াড ও বহুসংখ্যক চিকিৎসক পাঠানোর মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা হয়তো আবারও ‘ইতিবাচক অবস্থা’ দেখতে পারি।
বলে রাখা দরকার, ভূমিকম্পে তুরস্কের যে এলাকাগুলো খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেসব এলাকায় দেশটির বহু কুর্দি সংখ্যালঘুর বাস। এই অবস্থায় কুর্দি সংখ্যালঘু ও তুর্কি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যকার অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা সাময়িকভাবে হলেও কমতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এর কারণ, উভয় জনগোষ্ঠী একই পরিণতির শিকার। চলমান সংকটে কুর্দি সংখ্যালঘুদের প্রতি তুর্কি সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে অনেকটা মন খুলেই। এর ফলে সরকারের সমালোচনাকারী দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আগামী দিনে ইতিবাচক হয়ে উঠবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। ইসরাইলকে তুরস্কে সহায়তা পাঠাতে দেখেছি আমরা। তুরস্কের সরকারও একে সাদরে গ্রহণ করেছে। এই চিত্র দেশ দুটির জন্য ‘দীর্ঘমেয়াদি অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক’ বয়ে আনার পূর্বাভাস। উল্লেখ্য, এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান বিরোধের পর সম্প্রতি তুরস্ক ও ইসরাইলের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।
সিরিয়ার প্রতিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছে ইসরাইল। প্রতিবেশী সিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘অনুরোধ এলে সরকার সিরিয়ানদের জন্যও মানবিক সাহায্য পাঠাবে। সিরিয়ার কর্মকর্তারা অবশ্য ইসরাইলের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে সংকটকালে বিবদমান দেশগুলোর এভাবে এগিয়ে আসার প্রত্যয় সম্পর্কে ‘ইতিবাচকতা’ বয়ে আনে—এই দাবি অস্বীকার করা যায় না।
স্টেইনবার্গের মতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতা বিদ্যমান সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটা কাজ না-ও করতে পারে। বিশেষ করে যখন খুব তিক্ত দ্বন্দ্ব থাকে এমনকি কোনো ধরনের ইতিবাচক সংযোগের সম্ভাবনা থাকে না, তখন সাহায্য-সহযোগিতার প্রত্যয় খুব একটা কাজে আসে না।
দীর্ঘদিন ধরে চলমান সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আহত সিরিয়ানদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছে ইসরাইল। এসব নাগরিকের মধ্যে অনেক ‘বিরোধী বাহিনী’র লোকজনও রয়েছেন। একে ভালো চোখে দেখে না সিরীয় সরকার। মূলত এ কারণে দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনে কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগকালে এ ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া দুই দেশের সরকারের জন্য কিছুটা হলেও সম্পর্কের ভিত গড়ে দেয়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ইসরাইলের সাহায্যের প্রতিশ্রুতির পর সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে সামনের দিনগুলোতে আমরা অন্তত জোরালো পরোক্ষ সংলাপ দেখলেও দেখতে পারি।
সিরিয়া ও তুরস্কের প্রতি সাহায্যের ডালি সাজিয়ে দেশ দুটিতে উড়ে গেছেন ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিবর্গও। দেশ দুটিকে সহায়তা করতে পেরে বেশ গর্বই বোধ করছে ফিলিস্তিনের সরকার। আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী এবং ফিলিস্তিন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার মহাপরিচালক ইমাদ জুহাইরি বলেছেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি দায়বদ্ধ। এ ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দেশকে সাহায্য করতে পেরে আমরা গর্বিত। দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই আমরা দুর্যোগকবলিত মানুষের পাশে থাকতে চাই।’
পরিশেষে বলতে হয়, তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্পে দেশ দুটির সঙ্গে বিবদমান রাষ্ট্রগুলো যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে, তা বিশ্বরাজনীতি ও বিশ্বশান্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী চলমান নানামুখী উত্তেজনা ও দ্বিপাক্ষিক-বহুপাক্ষিপ বহু জটিল হিসাবনিকাশের মধ্যেও দেশগুলোর সরকারের এভাবে এগিয়ে আসা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এগিয়ে যাওয়ার বার্তাই বহন করে।