জলযুদ্ধে থেকেও একটু বৃষ্টি ঝরলেই যেন তৃপ্তি পান ৪০ পেরোনো মাফিয়া বেগম। ওই বৃষ্টির ফোঁটাই যে এখন মাফিয়াদের তেষ্টা মেটানোর রসদ। বিশুদ্ধ পানি মানে ওই মেঘ থেকে জল। এই পানিই তাঁদের নামিয়েছে বন্যার সঙ্গে লড়াইয়ে; বৃষ্টির জলই আবার দেখাচ্ছে বেঁচে থাকার পথ।
পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মা মাফিয়া। সিলেট নগরীর তেররতন এলাকায় রিকশাচালক স্বামী শিপন মিয়া ও সন্তানদের নিয়ে এক যুগ ধরে আছেন এই এলাকায়। সবার মতো বন্যার এমন রুদ্র রূপ আগে দেখেননি মাফিয়াও। তাঁর একচালা টিনের ঘরের ওপর দিয়ে বইছে ভীতি ছড়ানো বানের জলধারা। টানাপোড়েনের সংসারে গৃহস্থালির সামান্য যা কিছু ছিল, তা-ও ভেসে গেছে পানির তোড়ে। হাতের কাছে পাওয়া দু’খানা প্লাস্টিকের থালা আর দু’খানা পাতিল- তার কাছে হয়ে উঠেছে ‘অন্ধের যষ্টি’। মাফিয়ার ৯ জনের পরিবার এখন ঠাঁই নিয়েছে নগরীর উপশহর এলাকার উমরশাহ তেররতন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে। নিচতলায় কয়েকটি টেবিল জড়ো করে কোনোমতে মাথা গোঁজার চেষ্টা। সেখানেও পানির থৈ থৈ সুর। আশ্রয়কেন্দ্রে নেই পর্যাপ্ত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা। মশারও আছে যন্ত্রণা।
সবকিছু হারিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে বসে তীব্র ক্ষুধার যাতনা আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথা যখন শুরু করলেন, তখন মাফিয়ার দু’চোখের আঙিনায় বেদনার জল। তিনি বলছিলেন, ‘চার দিন ধরে দিনে মাত্র একবেলা চিড়া-মুড়ি খেয়ে বেঁচে আছি। বৃষ্টির ফোঁটা ধরেছি থালায়, সেটাই খাচ্ছি। সন্ধ্যা হলেই আঁধার নামে। প্রথম দিন মোম ছিল, এখন আর নেই। ছোট ছোট এত বাচ্চা নিয়ে অন্ধকারে রাত কাটাই। বাচ্চারা ভাতের জন্য চিৎকার করে কাঁদে। বুক ফেটে যায়! কীভাবে ওদের মুখে ভাত দেব! এখন পর্যন্ত কেউ এক থালা খিচুড়িও দেয়নি।’সবকিছু হারিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে বসে তীব্র ক্ষুধার যাতনা আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কথা যখন শুরু করলেন, তখন মাফিয়ার দু’চোখের আঙিনায় বেদনার জল। তিনি বলছিলেন, ‘চার দিন ধরে দিনে মাত্র একবেলা চিড়া-মুড়ি খেয়ে বেঁচে আছি। বৃষ্টির ফোঁটা ধরেছি থালায়, সেটাই খাচ্ছি। সন্ধ্যা হলেই আঁধার নামে। প্রথম দিন মোম ছিল, এখন আর নেই। ছোট ছোট এত বাচ্চা নিয়ে অন্ধকারে রাত কাটাই। বাচ্চারা ভাতের জন্য চিৎকার করে কাঁদে। বুক ফেটে যায়! কীভাবে ওদের মুখে ভাত দেব! এখন পর্যন্ত কেউ এক থালা খিচুড়িও দেয়নি।’
সিলেটের ডুবন্ত জনপদের আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও যাঁরা বন্যাকবলিত হয়ে নিজের বসতভিটা এখনও ছাড়েননি, তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই। বানভাসি অনেকের অভিযোগ, এমন বিপর্যয়ের সময়েও স্থানীয় অনেক রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে এখনও কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পাননি তাঁরা। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে কেউ খোঁজও নিতে যাননি। অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা বসে আছেন হাত গুটিয়ে। আশ্রয়কেন্দ্রে সবচেয়ে দুর্বিপাকে আছে শিশু ও বয়স্ক নারীরা। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীরা আছেন নানামুখী সংকটে। তবে এসব কেন্দ্রে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত কারও কাছে কোনো চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছেনি। অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য জরুরি চিকিৎসা সহায়তাও মিলছে না। বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত ও পানি নামতে দেরি করলে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকের সংখ্যা বাড়বে। এখনই নজর না দিলে মানবিক সংকটও আরও গভীর হবে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।রেকর্ড ভাঙা বন্যায় রাতারাতি অন্য চেহারায় পাশাপাশি দুই জেলা সিলেট ও সুনামগঞ্জ। সিলেট নগরীর অধিকাংশ এলাকা এখনও তলিয়ে আছে। বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। নগরের যেসব এলাকায় দিন-রাত যেখানে যানজট লেগে থাকত, সেখানে এখন ধুমসে চলছে নৌকা। অনেকের বাড়ির একতলা পর্যন্ত ডুবে আছে। সিলেট নগরে ঢুকতে প্রধান যে তিনটি পথ, সেখানে কোমরপানি। নগর ও আশপাশ এলাকায় যেসব ঘরবাড়ি ডুবে গেছে, সেখানকার বাসিন্দারা সরে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। মধ্যবিত্তদের অনেকে দূর-দূরান্তে থাকা তাঁদের আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠেছেন। নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও হতদরিদ্ররা ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।
‘ইশকুলে বাচ্চা অয়ে গেলে কী লজ্জা’: নগরীর কিশোরী মোহন আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১০০ পরিবারের গাদাগাদি বাস। তবে সেখানে ঠাঁই পাওয়া বৃদ্ধ মাজেদা বেগমের গল্পটা আবার আলাদা। পরনে তাঁর ছেঁড়া ফিনফিনে হলুদ শাড়ি। মাজেদার চোখে-মুখে গভীর দুশ্চিন্তার রেখা। বাইরে তখন ঝুম বারিধারা। আশ্রয়কেন্দ্রের জানালার গ্রিল ধরে বাইরে মাজেদার আকুল চাহনি। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাজেদা দুই ছেলে ও তাঁদের স্ত্রী নিয়ে এখানে উঠেছেন। মাজেদার স্বামী বছর দশেক আগে চলে যান না ফেরার দেশে। তবে এসব কোনো সমস্যা নয়, মাজেদার ভয় সন্তানসম্ভবা দুই ছেলের বউকে নিয়ে। তাঁরা দু’জনই ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এক বউয়ের নাম আয়েশা, আরেকজন রিপা। মাজেদা বললেন, ‘ইশকুলে বাচ্চা অয়ে গেলে কী লজ্জা! না আছে এখানে কাপড়চোপড়, না আছে পানি। এই পরিবেশে দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কীভাবে সামাল দেব। হাতে এক টাকাও নেই। আজ এক পিস পাউরুটি খাইয়্যা আছি। তিন দিন হয়ে গেল, একমুঠো ভাত খাইতে পারি নাই।’ এরপর মাজেদা যা বললেন, তা শুনে যে কারোর শরীরে দেবে কাঁটা। নগরীর জতরপুর এলাকায় ছিল তাঁদের বাস। হঠাৎ বন্যার পানি চলে আসায় ঘরের কোনো মালপত্র ও পোশাক সঙ্গে আনতে পারেননি। ঘরের ভেতর এসব জিনিস ঠিকঠাক আছে কিনা, তা দেখতে রোববার সাঁতার কেটে প্রায় বাসা পর্যন্ত চলেই গিয়েছিলেন এই বৃদ্ধা। শেষ পর্যন্ত নাকে-মুখে পানি চলে যাওয়ায় তাঁর বাসা পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। সাঁতার কেটেই আবার ফেরত আসেন তিনি।
নিজের মরণেও ভীত নন সুধীর মাঝি: নগরীর যেসব এলাকা সবচেয়ে বেশি জলমগ্ন, এর মধ্যে আছে উপশহর, শেখেরঘাট, নাছিরপুর, যতনপুর, চরপার ও সুরমার তীরবর্তী বিস্তৃত এলাকা। দুপুরে সুরমার তীরে গিয়ে সুধীর দাশের সঙ্গে দেখা। তিনি পেশায় নৌকার মাঝি। সবে নিজের ইঞ্জিনচালিত নৌকা করে আনা গোটা দশেক বন্যাদুর্গত ব্যক্তিকে নামিয়ে ঘাটে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সুধীর বললেন, ‘ছাতক, গোবিন্দগঞ্জ, লামাগাছিসহ আরও কিছু এলাকা থেকে তিন দিনে জনা দশেক লোককে উদ্ধার করেছি। এদের বাঁচাতে গিয়ে আমি মরে গেলেও আফসোস নেই। কয়দিন আর বাঁচুম! অন্তত কিছু মানুষকে বাঁচাতে পারলেও মরে শান্তি পামু।’
চুরির ভয়: সিলেট ও সুনামগঞ্জের অনেকে যাঁর যাঁর বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক ফাঁকা বাড়িতে পড়ে আছে দামি জিনিসপত্র। এ সুযোগে একটি চক্র দুর্গত এলাকায় চুরি করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইঞ্জিনচালিত বোটে এসে তারা ফাঁকা বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। নগরীর শেখঘাট এলাকার বাসিন্দা আবদুল আহাদ বলেন, গত দুই দিন রাতে এলাকায় চোর এসেছিল। দু’জন আগেই টের পেলে মসজিদের মাইক থেকে এলাকাবাসীকে চোরের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। এরপর চোরের দল অল্প কিছু চুরি করে পালিয়ে যায়। নগরীর ভাতালিয়া এলাকার বাসিন্দা আরফানুল হক বলেন, এরই মধ্যে চুরি-ডাকাতি প্রতিরোধে পাহারা বসানো হয়েছে।
তবে সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, ‘কোথাও চুরি-ডাকাতির সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। কোনো একটি মহল বিষয়টি নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। শনিবার রাতেও অনেক এলাকা থেকে চুরি-ডাকাতির কথা জানানো হয়। তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া যায়নি।’
জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ক্ষোভ-হতাশা: ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর বন্যার মুখোমুখি হলেও খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত শুকনো খাবার নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াননি অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি। সিলেটের দুর্গত এলাকা ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ অভিযোগ মিলেছে। সিলেট নগরীর সুরমা নদী লাগোয়া ১০ নম্বর ওয়ার্ড প্রায় তলিয়ে গেছে। গতকাল সরেজমিনে গিয়ে সেখানকার একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের একজন শেখ শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বন্যার এমন পরিস্থিতি যেমন জীবদ্দশায় দেখিনি, তেমনি দুর্গত মানুষের পাশে কেউ না দাঁড়ানোর এমন নজিরও দেখিনি। এলাকার কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন দুর্গত কারও খোঁজ নেননি। বন্যার পর তাঁর চেহারাও এলাকায় কেউ দেখেনি। সবুজ উদ্দিন নামের আরেকজন বলেন, কিছু এলাকায় দু’জন সামান্য খিচুড়ি ও চিড়া দিয়ে সহায়তা করলেও ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি প্রচার করছেন। দেখে মনে হচ্ছে, অভাবী লোকজনকে সহযোগিতায় প্রচারণা জরুরি। সিটি করপোরেশনের ২৭ জন কাউন্সিলরের মধ্যে একমাত্র শান্তনু দত্ত ছাড়া কেউ রান্না করা খাবার আশ্রয়কেন্দ্রে দেননি। নগরীতে রয়েছে ৩২ আশ্রয়কেন্দ্র।
বিভিন্ন এলাকার আরও একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, সিলেট ও সুনামগঞ্জের অধিকাংশ সংসদ সদস্য ঢাকায় বসে দুর্গতদের ব্যাপারে বক্তৃতা, বয়ান ও নানামুখী পরামর্শ দিচ্ছেন। এলাকায় এসে অনেকেই দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াননি। এখন পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেটের একজন মন্ত্রী ছাড়া দুর্গতদের দেখতে কেউ এলাকায় আসেননি। আশ্রয়কেন্দ্রের একাধিক বাসিন্দা বলেন, বিভিন্ন সংগঠন, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
এদিকে, আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্গতদের চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার ব্যাপারে অনেকের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় প্রথম দু’দিন আশ্রয়কেন্দ্রে চিকিৎসকরা পৌঁছাতে পারেননি। রোববার থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি। অনেক কেন্দ্রে চিকিৎসকরা যাচ্ছেন।সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, গেল দু’দিন আমরা দুর্গত মানুষকে উদ্ধারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এ জন্য ত্রাণ পর্যাপ্তভাবে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এখন ত্রাণ সহায়তার দিকে মনোযোগ দেব। পর্যাপ্ত ত্রাণ আমাদের হাতে রয়েছে।