ঢাকার বায়ুর চলমান অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি নিয়ে সবাই চিন্তিত। ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে মহামান্য হাইকোর্টও। সম্প্রতি হাইকোর্ট বলে, ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ দূষিত বায়ুর শহর হচ্ছে ঢাকা। বায়ুদূষণে ঢাকার এ অবস্থান ধারাবাহিক হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এটি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। যেটা দিল্লিতেও করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত এ বিষয়ে বলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের এখানে কারো কোনো খবর নেই। এই নির্লিপ্ততা অসন্তোষের কারণ।’ অনেকের জানা, ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি মহামান্য হাইকোর্ট ঢাকার বায়ুদূষণের ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। সেই ৯ দফা নির্দেশনাবলি ছিল পরিবেশের জন্য কল্যাণকর, ঢাকার জন্য মঙ্গলজনক। অথচ নির্দেশনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আর এ কারণেই মূলত মহামান্য হাইকোর্টের এই উষ্মা প্রকাশ।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশের আর্থিক মূল্যের সমান। দেশে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে প্রথম অবস্থানে আছে ঢাকা। অন্যদিকে সিলেট বিভাগে বায়ুদূষণ অপেক্ষাকৃত কম। বায়ুদূষণের প্রভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগতহারে বাড়ছে। দূষিত এলাকায় প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে শ্বাসকষ্ট। নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বয়স্ক ও শিশুরা। উল্লেখ করতে হয়, বায়ুদূষণ বিষণ্নতায় ভুগছেন বেশির ভাগ মানুষ। এই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বিশেষত সবচেয়ে বেশি বিষণ্নতায় ভুগছেন ৬৫ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সিরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে মাত্র ১ শতাংশ দূষণ বেড়ে গেলেই বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় ২০ গুণ। কী সাংঘাতিক বিষয়!
১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকার জনসংখ্যা ২ কোটি পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের মেগাসিটির ছয় নম্বরে অবস্থান করছে এই মহানগর। বিভিন্ন কারণে এই শহরের বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকাবাসীর আয়ু কমে যাচ্ছে দিন দিন—যা মাথাব্যথার বড় কারণ। আগে ইটভাটাকে প্রধান ‘কালপ্রিট’ বললেও এখন (জরিপ মতে) প্রধান কারণ হচ্ছে যানবাহনের কালো ধোঁয়া। মূলত শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, আলোদূষণ ছড়িয়ে পড়ে পরিবাহন খাত থেকে। যানবাহনের পাশাপাশি ইটভাটা, বস্তির আবর্জনা, কাঠ-কয়লা ও কেরোসিন দিয়ে রান্নার ধোঁয়া, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার ট্রাক ও দূরপাল্লার যানবাহনের ধুলা ও ধোঁয়া এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের ধুলার কারণে ঢাকার বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।
উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ ‘কন্ট্রোল ওয়ে’তে দূষণ কমাচ্ছে। তারা পুরোনো গাড়ি বাতিল করে দেয়। গাড়িতে তারা উন্নতমানের ইঞ্জিন ব্যবহার করে। আমরা নিম্নমানের ইঞ্জিন ব্যবহার করি। তারা গাড়িতে যে জ্বালানি ব্যবহার করে তার সালফারের মাত্রা ৫০-এর নিচে। অথচ আমাদের দেশে সেই মাত্রা ২০০০-এর ওপরে। কী ভয়াবহ ব্যাপার! এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। ঢাকায় সমন্বয়হীনভাবে গাড়ি চলাচল কমাতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে। উন্নয়নের পরিকল্পনাগুলোও পরিকল্পিত ও সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের আন্তঃসমন্বয়ের মাধ্যমেই করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র (যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন বিশ্ববিদ্যালয় ও রচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যৌথভাবে) একটি গবেষণা করেছেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে যে বায়ুদূষণ ঘটছে, তার অন্যতম কারণ আন্তঃসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ। ইরান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তানের শুষ্ক মরু অঞ্চল থেকে ধূলিকণা বাতাসে মিশে যায়। পশ্চিমা লঘুচাপের মাধ্যমে ধূলিকণাসহ ঐ বাতাস ভারতে প্রবেশ করে। এবং নভেম্বর থেকে ঐ দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এতে আরো বলা হয়, ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে মারাত্মক যানজট ও ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সেখানে প্রচুর পরিমাণে ধুলাবালিও বাতাসে মিশছে। মূলত এসব কারণেই ঢাকার বাতাস বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। গার্মেন্টস, শিল্পকারখানা ইত্যাদির বর্জ্য থেকেও দূষণ ছড়ায়। এসব থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে গাছপালা ও সবুজায়নের কোনো বিকল্প নেই। বসতিবিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন হ্যাবিটেটের হিসাব অনুযায়ী, একটি আদর্শ বড় শহরের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এলাকা সবুজ এবং ১৫ শতাংশ এলাকা জলাভূমি থাকতে হবে। কিন্তু ঢাকার সবুজ, জলাশয় ক্রমশ উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। ১৯৮৯ সালেও ঢাকা শহরের ১৭ শতাংশ এলাকা ছিল সবুজ গাছপালায় ঘেরা। ২০২০ সালে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ মাত্র ৩০ বছরে সবুজায়নের এত অধঃপতন! মূলত ২০০৯ সাল থেকে ঢাকার সবুজ ও জলাভূমি এলাকা সবচেয়ে দ্রুত হারে কমেছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের অনেক শহরে পরিকল্পিত সবুজায়ন করা হয়।
ঢাকাবাসীকে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচাতে দূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনাসহ যে আদেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট, সেগুলো আসলে পরিবেশবিদসহ সচেতন নাগরিকদের ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। ঢাকা শহরের মধ্যে বালি বা মাটি বহনকারী ট্রাকগুলো ও নির্মাণাধীন স্থান ঢেকে রাখা, ঢাকার সড়কগুলোতে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা, সড়কের মেগা প্রজেক্টের নির্মাণ ও মেরামত চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করা, ফিটনেসবিহীন ও কালো ধোঁয়ার যানবাহন জব্দ করা, লাইসেনবিহীন ইটভাটা বন্ধ করা, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া টায়ার পোড়ানো ও ব্যাটারি রিসাইকিলিং বন্ধ করা, মার্কেটের বর্জ্য যথাযথ অপসারণ ইত্যাদির মতো নির্দেশনা দেয় মহামান্য হাইকোর্ট। এসব নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে রাজধানী ঢাকাকে বসবাসযোগ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। এছাড়া পরিবেশসংক্রান্ত যেসব আইন আছে সেগুলোরও কঠোর হাতে বাস্তবায়ন করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে আইনকে যুগোপযোগী করতে হবে। এ জন্য সরকারের শাখাগুলো কাজ করছে বলেই আমরা মনে করি। বলে রাখা দরকার, সমন্বয়হীনতার জন্য একেক সময় একইস্থানে বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির কাজ দেখা যায়। এ প্রবণতা এড়িয়ে চলতে হবে। রাস্তাঘাট ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং মেরামতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। মোটকথা, বায়ুদূষণ থেকে আমাদের বাঁচতেই হবে। এজন্য শুধু আইন দিয়েই কাজ হবে না। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও হতে হবে সচেতন। কেবল সবার আন্তরিক প্রচেষ্টাতেই বাঁচতে পারে পরিবেশ। স্বাভাবিক পরিবেশে নিশ্চিত হতে পারে ‘সুস্থ জীবন’।