এ কথা সবার জানা, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নিম্ন-মধ্যবিত্ত। এদেশের সিংহভাগ মানুষ দিন আনে দিন খায়। এই যখন অবস্থা, তখন নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবন ধারণ দিনকে দিন কঠিনতর হয়ে উঠছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে তুলনায় মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। বলাবাহুল্য, এখন মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতেও মানুষের কপালের ঘাম ছুটে যাচ্ছে! বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট দিনমজুর-শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়েছে। অনেকে তিন বেলার খাবারও ভালোভাবে জোটাতে পারছেন না! এক সময় বাংলার সমৃদ্ধির কথা শোনা যেত। গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরুর কথা পূর্বপুরুষদের মুখে শোনা যেত। বিখ্যাত শাসক শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়ার কথাও আমরা শুনেছি। সে সময় নাকি বাংলার মানুষের ছিল না খাদ্যের অভাব। সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করত সবাই। কিন্তু আজকের অবস্থা বড়ই করুণ! সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জন্য প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হলো ভাত। বর্তমানে এক কেজি চাল কিনতে গুনতে হচ্ছে ৫৫ থেকে ৮০ টাকা। অর্থাৎ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের চাল কেনাই দায় হয়ে পড়ছে! নিত্যদিনের রান্না করার প্রয়োজনীয় উপকরণ তেল, পেঁয়াজ, সবজি, চাল, ডাল, চিনি, লাকড়ি ও নানা ধরনের শাক-সবজি কিনতেও মানুষকে টাকা বিহীন পকেটের দিকে তাকাতে হচ্ছে। শাক-সবজির দাম লাগামহীনভাবে তো বেড়ে চলেছেই, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জ্বালানির দাম। বেড়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উপকরণের দামও। দিনদিন পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, দুবেলা দুমুঠো উদরপূর্তি করাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, বিশেষ করে খেঁটে খাওয়া মানুষের জন্য। আমাদের দেশে দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য হলো আটা। মানুষের খাদ্যতালিকায় ভাতের পরই রুটির অবস্থান, যা প্রধাণত আটা বা গম দিয়ে তৈরি। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আটা ও গমের দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক বছরে আটার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর ফলে খাদ্য হিসেবে আটা ব্যবহারের পরিমাণ বহুলাংশে কমাতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। মাছেভাতে বাঙালি হিসেবে বিশ্বে আমাদের খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু আজ মাছের অত্যধিক দামের কারণে দেশের অধিকাংশ সাধারণ জনগণের মাছ কেনার সামর্থ্য নেই। মোটা দাগে উল্লেখ করতে হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জ্বালানির ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। যার ফলে যানবাহনের ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সব শ্রেণির জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর। বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস। অর্থাৎ জ্বালানির অতিরিক্ত দামের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে। সবমিলিয়ে ‘সংকট’ ঘিরে ধরছে মানুষকে!
এমতাবস্থায় সরকারকে নিত্যপণ্যের দাম জনগণের আওতার মধ্যে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মানুষের আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধির পরিমাণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের পরিমাণ স্থিতিশীল ও সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে হবে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার আশায় পণ্যসামগ্রী অবৈধভাবে মজুত করেন বলে অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে, আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে প্রতিবারের মতো অসাধু ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুতের কারণে যেন পণ্যের বাজারে অচলাবস্থার সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি সংকট মোকাবিলায় সরকারকে সচেতনভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকেও হতে হবে সচেতন। জনগণকে কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটতে তো হবেই, অসাধু সিন্ডিকেট যেন শিকড় গেড়ে বসতে না পারে, সে ব্যাপারেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।