বাঙালির ঐতিহ্যবাহী মাতৃভাষা বাংলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনে রয়েছে বহু সংগ্রাম ও ত্যাগের ইতিহাস। বাঙালিই প্রথম জাতি, যে নিজের ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে রাজপথে রক্ত দিয়েছে। ভাষাবিদদের মতে, বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ছয় হাজারের মতো ভাষা রয়েছে। যাদের মধ্যে অন্যতম আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষার বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য একে অন্যান্য ভাষা থেকে আলাদা করেছে। বাংলা ভাষায় রচিত ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম বারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন। বিশ্ব জুড়ে নিপীড়িত, অত্যাচারিত মানুষের পক্ষে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর জাগ্রত করেন নিজ মাতৃভাষায়, যা চমকে দেয় তৎকালীন বিশ্বনেতাদের। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো। এর মধ্য দিয়ে বাংলা বিশ্বদরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় আপন মহিমায়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার চর্চা, সংরক্ষণ ও মর্যাদা রক্ষায় আমরা বেশ উদাসীন! বাংলা ভাষার সঙ্গে বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণে ভাষার যে ‘সংকট’ সৃষ্টি হয়েছে, তার অভিঘাতে বাংলা ভাষা ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে আসছে!
উল্লেখ করা দরকার, ইউনেসকোর ভাষা সংরক্ষণবিষয়ক ইন্টারজেনারেশনাল ডিজরাপশনাল স্কেল যে ১৩টি অবস্থার ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, তার প্রধান বিপজ্জনক সংকেত হলো ‘তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেই ভাষা ব্যবহার কিংবা প্রয়োগ কমে যাওয়া।’ যা আমাদের ইরেজি মিডিয়াম প্রজন্মের মধ্যে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এছাড়া শব্দের ব্যবহার, উচ্চারণ, প্রয়োগরীতি, বানানবিকৃতির মতো কার্যক্রমগুলো শুভংকরের ফাঁকি হয়ে ভাষার সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার নিজের ভাষায় মত প্রকাশ করতে হীনম্মন্যতায়ও ভোগেন। অথচ বিশ্বে ভাষার সর্বাধিক ব্যবহারের তালিকায় বাংলার অবস্থান পঞ্চম। এসবের বড় কারণ, বিদেশি ভাষার তোষামোদি করা ব্যক্তিকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে মান্য করা আমাদের মধ্যবিত্তের মানসিকতা। যা আমাদের মাতৃভাষা চর্চার আকাঙ্ক্ষাকে নষ্ট করে দিচ্ছে চিরতরে। বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে, তবে তা মাতৃভাষার চর্চাকে উপেক্ষা করে নয়। বেশির ভাগ অভিভাবকই ছেলেমেয়েদের বিদেশি ভাষা শিক্ষায় শিক্ষিত করার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পড়ছেন। জাতি ভুলতে বসেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী—‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন।’
সাহিত্যচর্চা ভাষাচর্চার অন্যতম প্রক্রিয়া। অথচ আধুনিক নগরসভ্যতার ব্যস্ততায় আমরা ক্রমেই সাহিত্যচর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও উচ্চশিক্ষার অপ্রতুলতা বাংলা ভাষাকে ক্রমেই পিছিয়ে দিচ্ছে। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন, ‘যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করা সম্ভব নয়, তারা হয় বাংলা জানেন না, নয়তো বিজ্ঞান বোঝেন না।’ সত্যেন বোসের ভাবনায়, ‘বিশ্বের অনেক দেশ নিজেদের মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করলেও আমরা এখনো ব্যর্থ।’ ১৯৮৪ সালে এক নির্বাহী আদেশে সব সাইনবোর্ড বাংলায় হওয়ার নির্দেশনা থাকলেও বাংলা সাইনবোর্ডের বাস্তবায়ন এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দৃশ্যমান নয়। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হওয়ার পরও দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রমে এখনো বাংলার ছোঁয়া লাগেনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় আগ্রহী হয়ে বাংলা ভাষাকে আপন করে নিলেও হতভাগা বাঙালিরা এখনো নিজেদের ভাষার মর্মোপলব্ধি করতে পারেনি।
মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষা আমাদের অহংকার। যে ভাষার জন্য বীর শহিদেরা রক্ত দিয়েছেন, সে ভাষার অবমাননা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা ও শুদ্ধ বাংলা ভাষাচর্চায় সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের চেয়ে ব্যক্তি পর্যায়ের সচেতনতা ও মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ অতি জরুরি। বাংলা ভাষার সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সে সময়ের তরুণ সমাজ। তাই আবারও যখন বাংলা ভাষা সংকটকালীন অবস্থা পার করছে, তখন নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষার এই গুরুদায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের ওপরেই বর্তায়। ভুলে গেলে চলবে না, নিজের ভাষা জানা, ভাষার চর্চা করাটাও জাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্য। সেই কর্তব্য তখনই সফলভাবে পালন করা হয়, যখন বাংলা ভাষার ইতিহাস অধ্যয়নের পাশাপাশি বাংলা ভাষার একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাই ফেব্রুয়ারির অঙ্গীকার হোক—ভাষাগত উপনিবেশ ভেঙে শহিদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রক্ষা ও বাংলা ভাষার জন্য একটি সম্মানজনক ভবিষ্যৎ নির্মাণে তৎপর হওয়া।