ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর হতে আর মাত্র কয়েক দিন বাকি আছে। এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশ। অস্ত্র সরঞ্জাম তো বটেই, জ্বালানির বাজারও যেন দেশটির গায়ে আঁচ ফেলতে না পারে, তার যাবতীয় বন্দোবস্ত করে ইউক্রেনকে সমর্থনকারী দেশগুলো। ইউক্রেন আক্রমণ করার আগে ইউরোপের প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী ছিল রাশিয়া। যুদ্ধ সামনের দিকে গড়ানোর প্রথম দিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে দেখেছে বিশ্ব! পুতিনের চিন্তা ছিল, ইউরোপীয় দেশগুলো যেহেতু জ্বালানির প্রশ্নে রাশিয়ার ওপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল, সেহেতু ‘তেল অস্ত্র’ দিয়ে গোটা ইউরোপকে ঘায়েল করা যাবে। এই ভাবনা থেকে ইউরোপীয়দের ‘নেকড়ের লেজের মতো’ হিমায়িত করার হুমকিও দিয়েছিলেন যুদ্ধবাজ পুতিন। রাশিয়ার ওপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করা হলে শীত মৌসুমে ইউরোপ ভূখণ্ডকে বরফশীতল আবহাওয়ায় জমিয়ে মারার পরিকল্পনার কথা পুতিনকে বলতে শোনা গেছে বারবার। কিন্তু পুতিনের সেই ‘খায়েশ’ অপূর্ণই থেকে যায়! পূর্ব প্রস্তুতি ও সৌভাগ্যবশত হিমশীতল সময় প্রায় পার করে ফেলেছে ইউররোপ! বলা যায়, জ্বালানির সংকট ততটা বেকায়দায় ফেলতে পারেনি ইউরোপকে, যতটা মনে করা হয়েছিল। ব্ল্যাকআউটে গোটা ইউরোপ ডুবে মরবে—এমন বহু আশঙ্কা করা হলেও ইউরোপীয় দেশগুলো যে কোনোভাবেই হোক, সংকটকাল উতরে গেছে বেশ ভালোভাবেই। বরং এর অভিঘাত পড়ে ইউরোপের বাইরে। পাকিস্তান ও ভারতের মতো তুলনামূলক কম ধনী দেশগুলো পড়ে যায় চরম বেকায়দায়। রাশিয়ান তেল-গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিশেষ করে এশিয়ায় জ্বালানির দাম বাড়তে থাকে অস্বাভাবিক গতিতে। এর ফলে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে লড়াই করতে হয় তীব্র বিদ্যুদিবভ্রাটের সঙ্গে। শুধু বিদ্যুদিবভ্রাট নয়, এশিয়ার দেশে দেশে উৎপাদন-বিপণন মুখ থুবড়ে পড়ে নিত্যপণ্যের বাজার এতটাই অস্থির হয়ে ওঠে যে, বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দেয় ‘জন-অসন্তোষ’।
জ্বালানি বিশ্লেষক হিসেবে আমার দেখা এটা সর্বশেষ দৃষ্টান্ত—যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের সংকট দেখা দিলে তার বড় ভুক্তভোগীতে পরিণত হয় বিশেষ করে তুলনামূলক কম ধনী দেশগুলো। এর অভিঘাতে দেশগুলোর সরকার পড়ে তীব্র অস্থিরতার জ্বালামুখে। জ্বালানিসংকটের কারণে এসব দেশে উত্পাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়ে। এর ফলে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে প্রায় সব শ্রেণিপেশার মানুষের দুর্দশা চরম আকার ধারণ করে।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পালটা জবাব হিসেবে আগামী ১ মার্চ থেকে নতুন করে তেলের উৎপাদনে লাগাম টানা হবে। অপরিশোধিত তেলের দৈনিক উৎপাদন ৫ লাখ ব্যারেল কমিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, বর্তমানে দৈনিক যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করছে দেশটি, তা থেকে প্রায় ৫ শতাংশ কম উৎপাদন হবে ১ মার্চ থেকে। এর ফলে স্বভাবতই শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ তেল সরবরাহ কমবে বিশ্ববাজারে। বহু বিশ্লেষক মনে করেন, উৎপাদন ও সরবরাহ কমার আশঙ্কা রয়েছে আরো বেশি পরিমাণে। সত্যি সত্যিই যদি নতুন করে রাশিয়ান তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যায়, গরিব দেশগুলোর অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়।
পুতিন ‘জ্বালানি অস্ত্র’ পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করার পরও কীভাবে ইউরোপে বাতি জ্বলছে, তা ভেবে প্রথম দিকে অবাক হন বিশ্লেষকেরা। এর পেছনের কারণ খুঁজে দেখা যায়, রাশিয়া ভেতরে ভেতরে ইউক্রেন আক্রমণের যে নীলনকশা আঁকছে, ২০২১ সালের শেষে ও ২০২২ সালের শুরুর দিকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠলে আশু সংকটের কথা মাথায় রেখে সতর্ক হয়ে পড়ে ইউরোপের বহু সরকার। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করে বসলে মারাত্মক জ্বালানিসংকটের মুখে পড়বে ইউরোপ—জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের এই সতর্কবার্তাকে আমলে নিয়ে ‘সতর্কতামূলক ব্যবস্থা’ গ্রহণে উদ্যোগী হয় বেশ কিছু দেশ। এর সঙ্গে দেশগুলোকে সাহায্য করেছে ‘ভাগ্য’! পুতিনের জ্বালানি অস্ত্রের হাত থেকে ইউরোপকে রক্ষা পেতে সহায়তা করেছে ‘আবহাওয়া’। অতীতে শীতকালে ঠান্ডায় ইউরোপ জমে গেলেও এবারের চিত্র উলটো! সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউরোপে তেমন একটা ঠান্ডা পড়ছে না! এতে করে দেখা যাচ্ছে, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামের মতো মূল ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, মহাদেশীয় জ্বালানিসংকটের প্রশ্নে ইউরোপ অনেকটাই নিরাপদ!
তথ্য-উপাত্ত বলছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুতের দিক দিয়ে ইউরোপের গ্যাস সংরক্ষাণাগারগুলো বর্তমানে প্রায় ৬৭ শতাংশ পূর্ণ। এই শীতে ব্যবহার শেষেও ৫০ শতাংশ গ্যাস মজুত থেকে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে, যা পরবর্তী শীতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। কয়লার ক্ষেত্রেও অবস্থা একই রকম। সংকট সৃষ্টি হতে পারে—এই ভয়ে ব্যাপকভাবে কয়লা মজুত করা হয়। নতুন করে চালু করা হয় ২৬টি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্টগুলো চলছে অনেকটা নির্বিঘ্নেই।
এসবের সঙ্গে ইউরেপকে বাড়তি সুবিধা জুগিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর ইউরোপে রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানি সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বছরটিতে প্রতি মাসে প্রায় ১০ মিলিয়ন ঘনমিটার তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্র, যা ২০২১ থেকে ১৩৭ শতাংশ বেশি। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রায় ১ মিলিয়ন ব্যারেল পেট্রোল রপ্তানি করেছে, বিশেষ করে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে। ফ্রান্সও আমেরিকার পেট্রোল পেয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহের প্রশ্নে কোনো খামতি রাখেনি। যদিও এর জন্য বাইডেন প্রশাসনকে বহু কথা শুনতে হয়েছে দেশের মানুষের কাছ থেকে।
যা হোক, জ্বালানি যে ইউরোপের ওপর বোঝা হয়ে বসতে চলেছে—এমন আশঙ্কাকে খুব ভালোমতোই উতরে গেছে ইউরোপের সরকারগুলো। বিশেষত, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মাথায় যে দুশ্চিন্তা চেপে বসেছিল, তা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয় নির্বিঘ্নেই। এখন পর্যন্ত মারাত্মক বিপর্যয়ের কোনো সংবাদ শোনা যায়নি। এমনকি ‘মন্দা আসতে চলেছে’ বলে যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা-ও দূর হয়েছে বলা যায়। এ অবস্থায় সরকারগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে কীভাবে টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, সে ব্যাপারে ভাবার যথেষ্ট ফুরসত পাচ্ছে।
এ তো গেল ইউরোপের কথা। কিন্তু বিপরীত চিত্র কী বলে? আমরা দেখেছি, উন্নয়নশীল বিশ্বে, বিশেষ করে এশিয়ার পাকিস্তান, বাংলাদেশ এমনকি ভারতের মতো দেশগুলোতে মানুষ জ্বালানি নিয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থায় পড়ে যায়। বাস্তবতা হলো, যা কল্পনা করা হয়েছিল ইউরোপকে নিয়ে, তা ঘটেছে এশিয়ায়! ২০২২ সালে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের বৈশ্বিক দামে ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটায় এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলো পড়ে যায় গভীর সংকটে। একইভাবে ক্রমাগত দাম বাড়ার মুখে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বহু দেশ অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিদেশি জ্বালানি আমদানির ওপর অতিনির্ভরতা তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য এক দিক দিয়ে লাভও হয়েছে—এই কঠিন অভিজ্ঞতা দেশগুলোকে জ্বালানি নিয়ে নতুন করে ভাবার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ভারতের মতো অনেক দেশ নবায়নযোগ্য শক্তির বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে এখন। আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ যেমন—ইথিওপিয়া জলবিদ্যুতের উন্নয়নে ঝুঁকছে।
তবে এ কথাও সত্য, ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে তীব্র জ্বালানিসংকটে দরিদ্র দেশগুলো জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেখছে। এর ফলে কিছু দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এর ফলে পরিবেশের জন্য নেমে আসতে পারে বিপর্যয়। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, ধনী দেশগুলো পরিবেশসহায়ক জ্বালানি উৎপাদনে সক্ষম হলেও দরিদ্র দেশগুলোর সেই সক্ষমতা নেই। তাদের জীবাশ্ম জ্বালানির পথে হাঁটা ছাড়া বিকল্প নেই। সেই অবস্থায় তো পরিবেশ ও জলবায়ু পড়বে হুমকির মুখে!
তবে এ-ও মনে রাখা দরকার, বিশ্বের ধনী দেশগুলো ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে তুলনামূলক কম ধনী দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করা হবে। ‘ডিকার্বনাইজ’ সহায়তা বাবদ বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য করার কথাও বলা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশগুলোকে নির্ধারিত হারে ট্যাক্স দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যেসব দেশ ২০২২ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রেকর্ড গড়েছে, সেই সব দেশ থেকে তহবিল সংগ্রহের জন্য উন্নত বিশ্বকে অনুরোধ জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। এই অনুরোধে যদি কর্ণপাত করা না হয়, তবে জ্বালানিসংকটের হাত থেকে বাঁচতে বিশ্বের দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির পথে হাঁটতেই থাকবে। সেক্ষেত্রে পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর নেমে আসবে চরম বিপর্যয়। আর তার অভিঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া বিশ্বের জন্য কঠিনতর হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে জ্বালানিসংকটের হাত রক্ষা পেলেও জলবায়ু বিপর্যয়ে ডুবে মরা এড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।