বাঙালি জাতির প্রকৃত সূত্র বাংলা ভাষা। ‘একুশ’-এর সূত্র ধরেই প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ দশক পর উচ্চ আদালতে প্রথম বাংলা ভাষায় রায় ঘোষিত হয়। রায় ঘোষণার সময় (১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) বিচারপতি বলেছেন, ‘ভাষার মাস শুরু হলো। ভাষাশহিদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রথম রায়টি বাংলায় ঘোষণা করছি। বিশ্বের সব বাংলা ভাষাভাষীর প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলায় এ রায় ঘোষণা করছি।’ একই দিন সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটের ‘বাংলা সংস্করণ’ উদ্বোধন করেছেন প্রধান বিচারপতি। উল্লেখ্য, দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার হলেও উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় প্রদানের অন্যতম সমস্যা ছিল প্রয়োজনীয় অনেক বিদেশি শব্দের বাংলা পরিভাষা না থাকা। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজি সাড়ে ৪ হাজার শব্দের নতুন বাংলা পরিভাষা নির্ধারণ করেছে আইন কমিশন। আইন কমিশনের উদ্যোগে সব মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি বাংলা পরিভাষা নিয়ে মুদ্রিত হয়েছিল ‘আইন শব্দকোষ’। ইংরেজির রায় ও আদেশ অনুবাদের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তৈরি হয়েছিল ‘বাংলা অ্যাপ’।
উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় প্রদান একটি ঐতিহাসিক অর্জন। আইন কমিশনের বিভিন্ন উদ্যোগও বাংলা ভাষা বিস্তারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার মধ্যে অতিমাত্রায় বিদেশি, বিশেষ করে ইংরেজি শব্দ-বাক্য প্রয়োগের এ যুগে পরিভাষা প্রণয়ন অতি জরুরি বিষয়। বাংলা ভাষায় পরিভাষা প্রণয়নের সূত্রপাত মূলত কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হওয়ার পর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাংলা ভাষায় অনেক নতুন নতুন শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন। কিছু ইংরেজির অনুবাদ করে, কিছু পুরোনো শব্দ বা ধাতুর ওপর কাজ করে। অবশ্য, রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে পরিভাষা প্রণয়নের জোয়ার তত গতি পায়নি। দীর্ঘদিন পরে হলেও আইন মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিক পরিভাষা প্রণয়নের পথকে প্রশস্ত করেছে। বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেও এমন উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রযুক্তিগত প্রভাব ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির কারণে বর্তমানে সমাজের সব শ্রেণিকেই নতুন নতুন শব্দের সম্মুখীন হতে হয়। অনেক প্রয়োজনীয় শব্দের পরিভাষা না থাকায় বাংলা ভাষাপ্রেমীরা সমস্যায় পড়েন। শিক্ষা, প্রশাসন, ব্যবসায়, গবেষণা ও সরকারি পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রয়োজনীয় বিদেশি শব্দের বাংলা পরিভাষা না থাকার সমস্যাটিও প্রকট। এ সব ক্ষেত্রে পরিভাষা প্রণয়ন যেমন জরুরি তেমনি পরিভাষা প্রণয়নের পর তার ব্যবহার নিশ্চিত করাও প্রয়োজন।
বর্তমানে যেসব শব্দের পরিভাষা নেই, কিন্তু বাংলাভাষীদের ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়, সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তার কোনো নিয়মবিধি নেই। এটিও একটি বড় সমস্যা। বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ ব্যবহারের বর্তমান নিয়মনীতি যতটা ‘শ’, ‘স’-এর ব্যবহার বা উচ্চারণ বিষয়ক আধিক্যতায় পরিপূর্ণ, ততটা প্রত্যয় ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ফলে বহু ইংরেজি শব্দের আগে, পরে, মধ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলা ধ্বনি, বর্ণ ও প্রত্যয়। উপরন্তু ব্যাকরণের সহজ-সরল ও সমাধানযোগ্য অনেক বিষয় নিয়েও রয়েছে ভাষাপণ্ডিতদের ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথ। এ কারণেও বাংলা ভাষায় অনেক ধূম্রজাল তৈরি হয়। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবর্ণীকরণ বা লিপ্যন্তরও (এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষার বর্ণে লিখন) ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলার যথাযথ শব্দ-বাক্যকে বাদ দিয়ে ইংরেজি শব্দ-বাক্যকে বাংলায় প্রতিবর্ণী করার প্রবণতাও খুব বেশি। সাম্প্রতিক অনেক লেখা পড়েও মনে হয়, বাংলায় যথাশব্দ-অনুশব্দ-প্রতিশব্দ না জেনেই লেখকেরা ইংরেজি শব্দ বা ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত শব্দ-বাক্য বসিয়ে দিচ্ছেন। এ প্রক্রিয়ায় অর্ধেক ইংরেজি অর্ধেক বাংলা দ্বারাও বাক্য তৈরি করছেন। উপরন্তু ইংরেজি শব্দের প্রতিবর্ণীকৃত রূপের সঙ্গে বাংলার ই, ঈ, উ, ঊ-কার বসিয়ে শব্দের উচ্চারণও যত্রতত্র পরিবর্তন করা হচ্ছে। এ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিসংগ্রাম, পতাকা, চেতনা, বিপ্লব, স্বাধীনতা প্রভৃতি ঐতিহাসিক ও চেতনাদীপ্ত শব্দ বাদ দিয়েও ইংরেজি শব্দের লিপ্যন্তরণ ব্যবহার হচ্ছে। টেলিভিশন, বেতার ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমেও এ প্রবণতা লক্ষণীয়।
যথোপযুক্ত বাংলা শব্দগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আনকোড়া, অনুপযুক্ত শব্দ-বাক্য অধিক পরিমাণে প্রয়োগ করা হচ্ছে। অনেকের হেলাফেলা ও অজ্ঞতার কারণেও এমনটি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভুল-ঠিক নির্দিষ্ট করারও কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। বর্তমানে বাংলা একাডেমির ব্যাবহারিক বাংলা অভিধানে শব্দ সংখ্যা ৭৩ হাজার ২৭৯টি। একাডেমির বিবর্তনমূলক অভিধানে শব্দের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। অনেক নতুন এবং কৃতঋণ (অন্য ভাষা থেকে ধার করা হয়েছে এমন) শব্দ অন্তর্ভুক্ত করে ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে আধুনিক বাংলা অভিধান। রয়েছে আত্মীকৃত শব্দের অভিধানও। বাংলা একাডেমির ২৪টির বেশি অভিধান এবং বাংলা ভাষাবিষয়ক অনেক বইও রয়েছে। এসব গ্রন্থেও প্রচলিত বাংলা শব্দকে বাদ দিয়ে বিদেশি শব্দ বিশেষ করে ইংরেজি শব্দের প্রতিবর্ণীকৃত রূপের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। অভিধানগুলোতে অন্তর্ভুক্ত ও সর্বস্তরে স্বীকৃত বাংলা শব্দ-বাক্য বাদ দিয়ে বিদেশি শব্দ-বাক্য ব্যবহার করা যাবে না, এমন কোনো আইন দেশে নেই। বাংলাদেশে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ২০১২ এবং ২০১৪ সালে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও শুদ্ধ প্রয়োগে হাইকোর্টের রুল জারি হলেও, কার্যত তার শুভফল দৃষ্টিগোচর হয়নি।
বাংলা ভাষার মধ্যে বিদেশি শব্দ-বাক্য ব্যবহারের বর্তমান প্রবণতা নিয়ে জাতীয় কোনো উদ্যোগ না থাকলেও ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কিছু প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক আলোচনাসভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘…আমরা করপোরেশনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছি। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার সব সরকারি-বেসরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নামফলক বা চিহ্নফলক অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। কোনো ইংরেজি শব্দ বাংলা বর্ণ দিয়ে লেখা যাবে না।’ উল্লেখ্য, করোনায় আক্রান্ত অঞ্চল ভাগের সময়ও প্রায় সবার মুখে উচ্চারিত ইংরেজি ‘রেড জোন’, ‘গ্রিন জোন’ না বলে তিনি ‘লাল অঞ্চল’সবুজ অঞ্চল’ বলেছিলেন। বাস্তবে, জাতীয় কোনো কর্তৃপক্ষ থাকলে এ রকম উদ্যোগ যথাযথ বাস্তবায়ন করা কঠিন। আবার কোনটি ঠিক কোনটি ভুল তা মূল্যায়ন করাও জটিল।
বর্তমানে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ। বলা যায়, সব মিলিয়ে প্রায় ৪ লাখ। ভাব প্রকাশের জন্য বিদেশি শব্দ-বাক্যের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। অবশ্য, কোনো লোকই তার ভাষার সব শব্দের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে না। ইংরেজি ভাষায় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ শব্দ সব মিলিয়ে থাকলেও শেকসপিয়ার নাকি তার নাটকগুলোয় ১৫ হাজারের বেশি শব্দ ব্যবহার করেননি। বাংলা ভাষার শুদ্ধ-নির্ভুল শব্দকে বাদ দিয়ে, বাংলার মধ্যে যত্রতত্র বিদেশি ভাষার শব্দ-বাক্যের ব্যবহার করার বর্তমান প্রবণতা কতটা মর্যাদাহানির তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। তেমনি প্রয়োজন সময়োপযোগী পরিভাষা, বিদেশি শব্দের আত্তীকরণের বিধি, প্রতিবর্ণীকরণের নিয়ম ও বিদেশি শব্দে বাংলা প্রত্যয় ব্যবহারের নিয়মনীতি প্রণয়ন করা। অভিধানে বিধৃত বাংলা শব্দ-বাক্য ব্যবহারের জন্য একটি দিকনির্দেশনা থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা বাক্যের মধ্যে বিদেশি শব্দ-বাক্য বা বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত বাক্য একসঙ্গে ব্যবহার না করার বিধিনিষেধ করলেও বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।
ভাষা বহতা নদীর মতো। অজস্র ধারায় সমাজের নানা স্তরে এগিয়ে চলে তার ব্যবহার। তীরবিহীন জলরাশি যেমন প্রলয়ংকরী বন্যা সৃষ্টি করে তেমনি দিকনির্দেশনাবিহীন ভাষা-প্রতিবেশ ভাষার মৌলিকত্ব ও মর্যাদাকে বিপথগামী করে। ভাষাবিজ্ঞানীদের ‘চলমান প্রক্রিয়া’ বা ‘ব্যবহার সংখ্যাতিরিক্ত’ যুক্তি বিদ্যমান বিশৃঙ্খল বাংলা ভাষা পরিস্থিতিতে বাঞ্ছনীয় নয়, একমাত্র রাষ্ট্রভাষার দেশেও কাম্য নয়। চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রই তাদের ভাষাচর্চা, সংরক্ষণ এবং উত্কর্ষের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। আমাদেরও প্রয়োজন একটি সর্বজনীন উদ্যোগ, একটি সময়োপযোগী ভাষানীতি প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। ব্যাকরণবিদ, ভাষাবিদ, ভাষাতাত্ত্বিক বা ভাষাবিজ্ঞানীর সঙ্গে বাংলাকে ভালোবেসে যারা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে চান ভাষানীতি প্রণয়নের কাজে তাদেরও সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।