► প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট যাচ্ছেন আজ
► সুনামগঞ্জে খাবার পানির তীব্র সংকট
► হবিগঞ্জে ২২৬৪৩ হেক্টরের ফসল নিমজ্জিত
► মৌলভীবাজারে নারী-শিশু-বৃদ্ধরা বাঁধে
► আওয়ামী লীগের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম শুরু
► জামালপুরে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি
► শেরপুরে দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতি
সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ৭১টি আশ্রয়কেন্দ্র। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের গাদাগাদি। থাকার জায়গার সংকটের পাশাপাশি খাবার ও বিশুদ্ধ পানিও অপ্রতুল। সরকারি ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়।
সিলেট নগর ও কিছু কিছু এলাকায় পানি কিছুটা কমলেও জেলার অন্তত পাঁচটি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে জকিগঞ্জ উপজেলায় বাড়তে শুরু করেছে কুশিয়ারা নদীর পানি। শুক্রবার এই নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে গতকাল নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে করে জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সুনামগঞ্জে পানির তীব্র সংকট নিরসনসহ দুর্গতদের সহায়তায় কাজ করছে বিজিবি। মৌলভীবাজারে আশ্রয়ণের ঘর তলিয়ে যাওয়ায় নারী-শিশু-বৃদ্ধরা বাঁধে উঠেছেন। হবিগঞ্জে পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি। শেরপুরে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতি। জামালপুরে পানি বেড়ে নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরের অনেক এলাকা বন্যাকবলিত। কোথাও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সেসব জায়গায়ও দুর্গত মানুষের ত্রাণের চাহিদা বাড়ছে।
এদিকে আজ মঙ্গলবার সিলেট যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুর্গত এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ শুরু করেছে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটি। গতকাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম শুরু করা হয়। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে চিড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট, মোমবাতি, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও খাবার পানি।
সিলেটের বাসটিলা ও দক্ষিণ লালবাগ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে এলাকার বেশির ভাগ বাড়িঘর। যে দু-চার ঘরে মানুষ আছে, তারা বাসস্থান রক্ষার তাগিদে নিজেরা পাহারা দিচ্ছে। এলাকার বেশির ভাগ মানুষের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ দিচ্ছেন না, খোঁজখবরও নিচ্ছেন না। তেমনি একজন গোলবান বেগম। তিনি থাকেন বিমানবন্দর এলাকার পাশের বাইশটিলা এলাকায়। তাঁর পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৬। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘরো পানি আমরার। কিছু খাইবার নাই। কেউ আমরার খোঁজও নেয় না। আমরা কী হালে আছি দেখইন। ’
ত্রাণ পাবেন, এমন ভেবে এই প্রতিবেদকের দিকে ছুটে আসেন এলাকার দিনমজুর পরেশ শর্মা। পরে পরিচয় পাওয়ার পর তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পানি কমি গেলেও সব ডুবি রইছে। আমরা আজ তিন দিন তাকি এক বেলা খাইয়া টিকিয়া আছি।
বাইশটিলার বাসিন্দা আজগর আলী বলেন, ‘সরকারর পক্ষ তাকি আমরা কেউ কোনো ত্রাণ পাইছি না। দুই-চাইরজন আইছিলও, তারা দি গেছেগি। চেয়ারম্যানরে একবারউ দেখা গেছে না। আমরা চাই আমরার ইনো ত্রাণ দেওয়া অউক। ’
নগরের শাহ পরান সরকারি কলেজ, মির্জাজাঙ্গাল উচ্চ বিদ্যালয়, মেন্দিবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়, টেকনিক্যাল স্কুল, আইডিয়াল স্কুল, লামাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাসিবা খাতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়, সোনারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব কেন্দ্রেই খাবার ও সুপেয় পানির সংকট।
সুনামগঞ্জ শহরের পুরাতন বাসস্টেশন এলাকায় গতকাল বিকেলে পাঁচ দিন পর কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ চালু করে পিডিবি। এ সময় পানি ও মোবাইল ফোন চার্জের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। গতকাল বৃষ্টিপাত না হওয়ায় অল্প পানি কমেছে। তবে ৯০ শতাংশ বাসাবাড়িতে এখনো পানি।
এদিকে খাবার পানির জন্য ছুটছে মানুষ। জরুরি ওষুধ খাওয়ার জন্যও পানিবন্দি মানুষ পানি পাচ্ছে না। এগিয়ে এসেছে সুনামগঞ্জ-২৮ বিজিবি। তারা হাই ভোল্টেজের জেনারেটরে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে গভীর নলকূপ থেকে পানি তুলে সরবরাহ করছে।
সুনামগঞ্জ শহরের হক হোটেলের স্বত্বাধিকারী জিয়াউল হক তাঁর হোটেল থেকে দুই বেলা হাজারো বানভাসি মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করছেন। শহরতলির আশপাশে বানভাসি মানুষকে ত্রাণ, খাবার পানি, চিকিৎসা, ওষুধ ও রান্না করা খাবার দিয়ে যাচ্ছে সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবি।
শহরের মল্লিকপুরের বাসিন্দা স্বপন মিয়া বলেন, ‘আমার পাড়ার একজন পানির জন্য অষুধ খেতে পারছে না। পান করা তো দূরের কথা। পরে খবর পেয়ে বিজিবি ক্যাম্প থেকে পানি নিয়েছি। ’
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এখনো আমাদের বিদ্যুৎ, যোগাযোগ বন্ধ। শহরের একটি অংশের কিছু স্থানে সামান্য বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। সব জায়গায় চালু করতে সময় লাগবে। ’ তিনি বলেন, ‘এখন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডসহ জেলা প্রশাসন ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে। আমরা ৪৫০ আশ্রয়কেন্দ্রে এক লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ স্যালাইন দিচ্ছি। ’
মৌলভীবাজারে মনু নদীর পানি বাড়ছে। এতে নদীর তীরে গড়ে ওঠা ৪১টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে কোমরপানি, দুর্ভোগে নারী-শিশুরা। শিশু, বৃদ্ধ, নারী—সবাই পাশের মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। রবিবার খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ও চাঁদনীঘাট ইউপি চেয়ারম্যান আখতার উদ্দিন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সরকারিভাবে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি বলে জানান ভুক্তভোগী রুমা বেগম, রহিম মিয়াসহ অনেকে।
মৌলভীবাজার সদরের ইউএনও সাবরিনা রহমান বলেন, ‘তারা এখন নিরাপদে আছে। সরকারিভাবে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
হবিগঞ্জ জেলার চারটি উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি। জেলার ১১৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে আট হাজার ৭৭৪টি পরিবার। সরকারি হিসাবে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ১৫ হাজার ২০০।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বন্যার পানিতে ছয় হাজার ৭৭৮ হেক্টর আউশ, ১৪ হাজার ৩৩৫ হেক্টর বোনা আমন এবং এক হাজার ৫৩০ হেক্টর জমির শাক-সবজি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার পানি নেত্রকোনা হয়ে কিশোরগঞ্জে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। ইটনা ও করিমগঞ্জ উপজেলায় পানি বেড়ে যাওয়ায় গতকাল ১৫টি গ্রামের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, গত শনিবার থেকে জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এ পর্যন্ত জেলার আট উপজেলার ৫০টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্তদের সহায়তায় এ পর্যন্ত ১৪০ মেট্রিক টন চাল, আড়াই লাখ টাকা সহায়তাসহ শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে।
সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনায় বন্যার পানি না বাড়লেও দুর্গত মানুষের দুর্দশা বেড়েছে। এখনো দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নেই পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী ও চিকিৎসাসেবা মিলছে না। নানা ধরনের দেখা দিচ্ছে রোগবালাই। গতকাল পর্যন্ত অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে কোনো চিকিৎসক যাননি। কোনো কোনো কেন্দ্রে ত্রাণ পৌঁছেনি।
এদিকে উজানের পানি নামার ফলে জেলার দক্ষিণের চরাঞ্চলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়তে শুরু করেছে। শেরপুর সদরের চরপক্ষীমারী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আকবর আলী জানান, কুলুরচর-বেপারিপাড়ার ব্রহ্মপুত্র নদের চরে বসবাসকারী পরিবারের শতাধিক ঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ঘরে পানি ওঠায় অনেকেই পাশের উঁচু স্থানে ও জামালপুর শহরের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। বিকেলে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার শফিকুর রেজা চৌধুরী ঝিনাইগাতী উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন।
জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। এ ছাড়া জেলার ইসলামপুর উপজেলায় পশ্চিম চিনাডুলি গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে আরিফা আক্তার (৭) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মাদারগঞ্জ উপজেলার গ্রাবের গ্রামে নবনির্মিত একটি কাঁচা রাস্তা ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে।