আমাদের দেশে হরেক রকম চুরির কথা শোনা যায়। এবার শোনা গেল সুন্দরবনে বাঘশুমারির (গণনা) কাজে ব্যবহূত আটটি ক্যামেরা চুরির কথা। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা জানতে গত ১ জানুয়ারি সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় শুমারির কাজ শুরু করে বন বিভাগ। শুমারির জন্য সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকার গাছে ৩৩০টি ট্র্যাকিং ক্যামেরা বসানো হয়। এর মধ্যে আটটি ক্যামেরা চুরি হয়ে গেছে।
খালচুরি, পুকুরচুরি, নদীচুরি—এমন অনেক রকম চুরির কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু বাঘশুমারির ক্যামেরা চুরির কথা শুনিনি। চুরির ইতিহাসে ঘটনাটি অভিনব। অবশ্য এতে খুব বেশি অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। কথায় আছে, চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা। এই চুরিবিদ্যা দশ মহাবিদ্যার অন্তর্গত প্রধান এক বৃত্তি। যদিও ধর্মগ্রন্থে চৌর্যকর্ম বা চুরিকে নিষিদ্ধ কর্ম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনি।
চুরি বা চৌর্যবৃত্তি অত্যন্ত প্রাচীন পেশা। ঋগ্বেদে চোরদের কথা উল্লেখ আছে, বাইবেলেও আছে। যে সময় ঋগ্বেদ রচিত হয়েছিল তখন প্রধান ক্রাইম ছিল চুরি। তখনকার সমাজে প্রধান সম্পত্তি ছিল গরু। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১০৮ সূক্তে রয়েছে এরকম এক গল্প—বিদেশি একদল ডাকাত বা বেনে, যাদের নাম ‘পণি’, তারা লুকিয়ে এসে দেবতাদের গরু চুরি করে চম্পট দেয়। দেবতারা তাদের হারানো গরুর খোঁজ পেতে নিয়োগ করেছিল কুক্কুরী সরমাকে। এই সরমা থেকেই পরবর্তী কালে ‘সারমেয়’ শব্দটার উৎপত্তি। যাহোক, সরমার দেওয়া খবরের সুবাদে দেবতারা তাদের হূত সম্পদ পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। জাতক-মালা বা অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যেও উল্লেখ রয়েছে চৌর্যবৃত্তির। বেদের কাল থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসা এই পেশার মানুষকে ভয়ে ও শ্রদ্ধায় কত নামই দিয়েছে তা বলা মুশকিল, তার মধ্যে কিছু শ্রুতিমধুরও, যেমন—নিশি-কুটুম্ব বা স্কন্দোপজীবী।
প্রশ্ন উঠতে পারে চোর কি সবাই হতে পারে? না পারে না। ভালো চোর হতে গেলে যে বিস্তর গুণাগুণের অধিকারী হওয়া আবশ্যক তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে মৃচ্ছকটিক নাটকে। সেখানে কীর্তিমান চোর স্বগতোক্তি করেছে :‘আমি বিড়ালের ন্যায় নিঃশব্দে গমন করতে পারি। মৃগের ন্যায় দ্রুতবেগে দৌড়াইতে পারি। শ্যেন পক্ষীর ন্যায় সহসা গ্রাহ্য বস্তু ধরিতে ও খণ্ড খণ্ড করিতে পারি। কুক্কুরের ন্যায় নিদ্রিত ও জাগরিত ব্যক্তির বল পরীক্ষা করিতে পারি। সর্পের ন্যায় বক্ষোপরিও গমন করিতে পারি। এবং আমি নানাবিধ রূপ ধারণে ও বিবিধ বেশ বিন্যাসে ঐন্দ্রজালিকের সদৃশ, সর্বদেশীয় ভাষার উচ্চারণে দক্ষ, এবং স্থলপথে ঘোটকের ও জলপথে নৌকার তুল্য।
চোরের কিন্তু আলাদা কোনো জাত নেই। চোর যে কেউই হতে পারে, অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, এমনকি ব্রাহ্মণ হয়েও চোর হতে পারে। মৃচ্ছকটিক নাটকের শর্বিলক ব্রাহ্মণ হয়েও চৌর্যবিদ্যায় পারঙ্গম।
একসময় কবিরাও সিঁদ কেটে চুরি করতেন। প্রাচীন এক কাহিনি মতে, একবার এক কবি চোর সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে রাজা ভোজের ঘরে। ভোজরাজ মস্ত কবি। জানালায় বসে আকাশের চাঁদ নিয়ে কবিতা রচনা করছেন। রাজাকে দেখে চোর অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ল। রাজা এক ছত্র লেখেন আর নিজেই আবৃত্তি করে ওঠেন। শেষে এক ছত্রে গিয়ে রাজা পড়লেন ফাঁপরে। কিছুতেই মিল খুঁজে পান না। এদিকে চোরও স্বভাবে কবি। আত্মবিস্মৃত হয়ে পরের ছত্র সে আবৃত্তি করে ওঠে ছন্দ-অর্থ মিলিয়ে। ব্যস—শুরু হয়ে গেল রাজবাড়িতে হইচই। রাজবাড়িতে চোর পড়েছে। অতঃপর চোর গ্রেফতার। পরদিন বিচারের জন্য চোরকে আনা হলো রাজসভায়। তখন শাস্তি ছিল শূলে চড়ানো অথবা হাত কেটে ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু রাজা অন্য চরিত্রের। গুণীর কদর করতে জানেন তিনি। তাই শাস্তির বদলে রাজা চোরকে দিলেন ১০ কোটি স্বর্ণমুদ্রা—রাজার পাদপূরণের পারিতোষিক। আর দিলেন কবিসম্মান।
সবকিছুর যেমন নিয়ম আছে, চুরি করার ক্ষেত্রেও আছে। এজন্য গুরুর কাছে তালিম নিতে হয়। পূর্ণমাত্রায় চৌরবিদ্যায় পারঙ্গম হওয়ার জন্য প্রয়োজন অসীম মনঃসংযোগ ও পরিশ্রম। দেহ আর মনের ওপর স্থাপন করতে হয় সম্পূর্ণ আধিপত্য। আয়ত্ত করতে হয় বিভিন্ন পশুপাখির ডাক, যা চৌরকর্মে প্রয়োজন হতে পারে যে কোনো সময়। শিয়ালের ডাক শিখতে হয় সবার আগে। যেহেতু চোরের কাজ মূলত অন্ধকারে, তাই চোখ ও কান দুটো ইন্দ্রিয়কেই হতে হয় অত্যন্ত প্রখর। দুই ইন্দ্রিয় প্রাখর্যই নয়, ইন্দ্রিয়সংযমও অসীম প্রয়োজন চৌরবিদ্যায় পারদর্শী হতে গেলে। সন্ন্যাসী হতে গেলে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু চোর হতে গেলে কাঞ্চনমোহ থাকলেও কামিনীর মোহ নৈব নৈব চ। তাই চোর অর্ধসন্ন্যাসী। চুরি করতে গেলে প্রথমেই দরকার চুরির যোগ্য জিনিসের খোঁজ, যে বাড়িতে আছে তার নকশা, বাড়ির বাসিন্দাদের গতিবিধি। এসব খোঁজ দেওয়ার জন্য থাকে খোঁজদার বা খুঁজিয়াল।
সিঁদকাটাও ছিল কঠিন এক কাজ। এটা রীতিমতো শিল্পকর্ম। খন্তায় করে ধীরে ধীরে শুরু করতে হবে মাটি কাটা—অত্যন্ত নরম হাতের কাজ। সঙ্গী লোক দুহাতে অঞ্জলি পেতে সিঁদের নিচে ধরে থাকবে। মাটি যা পড়বে সব হাতের ওপর। সঙ্গে হাঁড়ি থাকলে ভালো। হাতভর্তি মাটি হাঁড়িতে করে ফেলে আসতে হবে দূরে। সিঁদ কেটে দেওয়াল একেবারেই ফাঁক করতে নেই, কিছু বাকি রেখে দিতে হয়।
যেনতেন প্রকারে সিঁদ কাটলে চলবে না, দেহের মাপজোক সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা চাই, যাতে সিঁদের মধ্যে দিয়ে নিজের পুরো শরীর গলিয়ে দেওয়া যায়। সিঁদকাঠি ছাড়াও সঙ্গে রাখতে হবে সুতো। সুতোর অনেক কাজ। হয়তো দরজায় খিল দেওয়া আছে—সুতোর মাথায় বড়শি গেঁথে দাও নামিয়ে। তারপর বড়শি দরজার খিলে আটকে গেলে সন্তর্পণে সুতোতে দাও টান। এছাড়াও আছে। রাত্রিবেলা অন্ধকারের মধ্যে বসে কাজ—হয়তো সাপে দিল কামড়ে। ঐ সুতোয় তাগা বেঁধে তখন যাওয়া যাবে ওঝার বাড়ি।
যদি মনে হয় কেউ হালকা জেগে আছে, তার জন্য আছে ঘুমপাড়ানি মন্ত্র, যাকে চলতি ভাষায় বলে নিদালি মন্ত্র, বেদের কালে একে বলা হতো অবস্বপনিকা। এই মন্ত্রে হালকা ঘুম গভীর হয়, আর জেগে থাকা মানুষ ঘুমে অচেতন হয়ে যায়।
এ ছাড়া রয়েছে হরেক রকমের গাছ-গুল্মের ব্যবহার। ঘরে ঢুকে কিছু পাতা যে খাটে গৃহস্বামীর শুয়ে আছে তার খাটের তলায় রেখে আগুন ধরিয়ে দাও। আগুনটা নিভিয়ে দিলে ধোঁয়া বের হবে। ধোঁয়া নাকের ভেতর গেলে সমস্ত শরীর আচ্ছন্ন হয়ে আসবে। আরো আছে—সেই পাতার বিড়ি থাকবে চোরের মুখে। একদিকে চলবে নিপুণ হাতের কাজ, অন্যদিকে কান থাকবে মক্কেলের নিঃশ্বাস ওঠা-নামার ওপর। উশখুশ শুনলেই বিড়িতে টান দিয়ে পরিমাণ মতো ধোঁয়া ছাড়বে নাকে। ব্যস, কেল্লা ফতে!
সিঁদ কাটা আর ভেতরে ঢোকার আগে ভেতরে কেউ জেগে বসে আছে কি না, বোঝার জন্য রয়েছে নকল মানুষ প্রবেশ করানোর রীতি। একে বলা হয় প্রতিপুরুষ—‘প্রতিপুরুষং নিবেশয়ামি’। ঘরে ঢুকে প্রথম কাজ দরজা খুলে ভেজিয়ে রাখা, যাতে পালাতে কোনো অসুবিধা না হয়—‘আত্মরক্ষার্থং দ্বারমুদ্ঘাটয়ামি’ আর পুরোনো দরজা খুলতে গিয়ে যদি শব্দ হয়? তারও উপায় আছে—দরজার জোড়গুলো জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া।
সিঁদকাঠি দুই ধরনের—একটা ত্রিকোণ ফলাযুক্ত, এতে মাটির দেওয়াল কাটা যায়। আর একটার মাথা চতুর্ভুজের মতো, এটি পাকা দেওয়াল কাটতে ব্যবহার করা হয়। কাপড়ের নিচে ঊরুর সঙ্গে কাঠি বেঁধে নিতে হয়। লোকের নজর পড়ে না। হালকা জিনিস বলে হাঁটা, আর প্রয়োজন হলে দৌড়াতেও সমস্যা নেই। তবে সিঁদ কি সকলের ঘরে কাটা যায়? না, চৌরনীতি শাস্ত্রের নিষেধ :‘ব্রাহ্মণ সজ্জন দাতা বৈষ্ণব তিন জন/ ইহার ঘরে চুরি না করিও কখন।’
এছাড়াও আছে : রোগী থাকলে সে বাড়ি কখনো ঢুকবেন না। ভ্রষ্টা মেয়ের বাড়ি যাওয়া চলবে না। লম্পট ছেলেছোকরা থাকলে সেখানেও না—রাতের বেলা কোনো ফিকিরে চুপ করে বেরিয়ে পড়বে।
তখনকার দিনে চুরি করে ধরা পড়লে কঠিন শাস্তি পেতে হতো। শূলে চড়ানো বা প্রাণ হনন। এছাড়া কাঁটার বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়। ছাইভর্তি বস্তায় মুখ ঢুকিয়ে সেই বস্তা বেঁধে দেয়। নাক ও কানের ফুটোয় দেওয়া হতো মরিচের গুঁড়ো। ছিল আরো হরেক অভিনব পদ্ধতি।
অবশ্য সন্দেহের বশে প্রাণ হননের বিরুদ্ধে আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে মনু সতর্ক করে দিয়েছেন চোরাই মাল ও সরঞ্জাম সবশুদ্ধ হাতেনাতে ধরলে তবেই চোর সাজা পাবে, নয়তো নয়। এই নিয়ম চালুর পর থেকেই চোরেরা রেহাই পেতে শুরু করে। চোরেরা নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছে মহামন্ত্র :চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা। এ যুগে কার চুরি কে থামাবে? কার চুরি কে ধরবে? চোর সমাজ আজ যে গুণীর আসনে!