আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখনো অজ পাড়াগাঁয়ে থেকে সারা পৃথিবীতে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তখন ভর্তিতে বয়সের বাধ্যবাধকতা না থাকায় দূরের গ্রাম থেকে পড়তে আসা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়রা অনেকে আমার সহপাঠী ছিল। তাদের কেউ কেউ প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দিয়েছিল। সেই সহপাঠীদের অনেকে এখন এই ধরাধামে নেই।
আমরা সবাই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের ভয় পেতাম। তবে অপেক্ষাকৃতভাবে ‘হেড স্যারকে’ বেশি ভয় পেতাম। কারণ তার পাঠে ঠিকমতো উত্তর দিতে না পারলে শাস্তি ছিল অবধারিত। সে শাস্তির ধরন অনেকটাই আলাদা ছিল। সেটা হলো ছোটদের দিয়ে বড়দের কানমলা দিয়ে দেওয়া। আকারে ছোটরা অনেক সময় লম্বা-বড়দের কান পর্যন্ত হাত পৌঁছাতে পারত না। তখন তাদের নিচু হতে বলা হতো। কানমলা যাতে না লাগে, সেজন্য কেউ কেউ কানে সরিষার তেল মেখে ক্লাসে আসত।
কিন্তু একজন ছিল কিছুটা বখাটে। সে কানমলা খেতে মাথা নিচু করতে চাইত না। একদিন সে ‘বাড়ির কাজ’ প্রস্তুত করে আনেনি। সেজন্য কানমলা খেতেও অনীহা ছিল। স্যার কয়েক বার মাথা নিচু হতে বললেও সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বারবার আদেশ অমান্য করায় স্যার ওর জন্য বাঁশের কাঁচা কঞ্চি আনতে বললেন আমাদের আরেক সহপাঠীকে। স্কুলের লাগোয়া মাকলা বাঁশের ঝাড় থেকে দ্রুত একটি কঞ্চি ছিঁড়ে আনা হলো। এরপর শপাং শপাং মার। স্যার ওকে শাসন করে আমাদের সবাইকে সতর্ক করেছিলেন, পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে কী হতে পারে। কিন্তু মার দেওয়ার পর স্যার ওকে জড়িয়ে ধরে নিজেই কেঁদেছিলেন। আর বলছিলেন আমি তোদের মতো গাধাগুলোকে পিটিয়ে মানুষ বানাতে চাই। সেই মারের দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। সে যুগে স্কুলের বাচ্চাদেরকে শাস্তি দিলে অভিভাবক বা কেউ প্রতিবাদ করতে আসত না। বাচ্চারাও কোনো গাফিলাতি বা অপরাধ করতে সাহস করত না। অতীতে বেপরোয়া শিক্ষার্থীদের শাসন ও ভালোবাসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
আজকাল যুগের হাওয়া বিপরীত হয়েছে। শিক্ষার্থীদেরকে শাস্তি দেওয়ার নিয়ম উঠে গেছে। পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব, নৈতিক মূল্যবোধগুলো ঠিকমতো তাদের ভেতরে গড়ে ওঠে না। ফলে অপরাধ করতে ভয় পায় না। অভিভাবক ও শিক্ষকদের মোটেও ভয় পায় না। পড়াশোনাও ঠিকমতো করতে চায় না। তারা বাড়িতে মা-বাবার কথা শোনে না, অন্যদিকে স্কুলের নিয়মকানুনও মানতে চায় না। কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা কোনো শিক্ষার্থীর ওপর রাগ করলে এবং সেটা বাড়িতে গিয়ে তার অভিভাবকের কানে পৌঁছালে পরে দলবলসহ শিক্ষককে নাজেহাল করা হয়। শুধু প্রাথমিক বা হাইস্কুলই নয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় একই অবস্থা। শিক্ষকরা সরাসরি কোনো শিক্ষার্থীর অন্যায় কাজের জন্য শাস্তি দিতে গিয়ে অজানা আতঙ্কে থাকেন। এজন্য বহুলাংশে দায়ী ছাত্ররাজনীতির নামে দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা রাজনীতির হীন স্বার্থ।
আমাদের সময় ছাত্ররাজনীতি ছিল ছাত্রকল্যাণের নিমিত্তে বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ের একটি প্ল্যাটফরম। ছাত্ররা ছিল ভলান্টিয়ার সেবাদানকারী। কোনো অন্যায় দেখলে তারা দল-মতের তোয়াক্কা না করে সব ছাত্রের কল্যাণে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এখন সেটা অতি লাভজনক বৃত্তিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের দাবিদাওয়া আদায় ও কল্যাণের পথ থেকে যখন ব্যক্তিগত অর্থ রোজগারের বা আয়ের পথ দেখানো শুরু করেছে, সেদিন থেকে এর বিষবাষ্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এখনকার দিনে ছাত্ররাজনীতি একটি বড় লাভজনক প্রতিষ্ঠান। অনেকে মজা করে বলেন, এটা এখন ‘পিডিপি’র মতো নতুন ‘পেট ধান্ধা পার্টিতে’ রূপ নিয়েছে।
দুদিন আগে বাংলা একাডেমির বইমেলায় আগতদের কাছে চাঁদাবাজির অভিযোগে হাতেনাতে গ্রেফতারকৃত ঢাবির দুই ছাত্রনেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রাবি, ইবি ও ইডেন কলেজের ঘটনা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। বিভিন্ন কৌশলে নির্মাণ-ঠিকাদারির কাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে। হলের সিট নিয়ে বাণিজ্য চালানো নির্যাতনের ঘটনা কতটুকু ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তা সাম্প্রতিক বুয়েট, ইবি ও রাবির কিছু শিক্ষার্থীর নির্যাতনের ঘটনা থেকে আঁচ করা যেতে পারে। এছাড়া ক্যাম্পাসের আশপাশের রেস্তোরাঁ মালিক ও হলের ডাইনিং কর্মীরা তাদের ফাও খাওয়া নিয়ে তটস্থ থাকেন সব সময়। কয়েক দিন আগে একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একটি হোটেলমালিকের লাখ লাখ টাকা বাকি খাওয়ানোর ফলে ব্যবসায় দেউলিয়া হওয়ার সংবাদ দেশবাসী জেনেছিল।
এরা বেপরোয়াভাবে চলে। কারণ এদের জন্য কোনো শাস্তির বিধান কোথাও নেই। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসুস্থ রাজনীতির মাত্রাটা নির্যাতক ও নিপীড়কের বেশে বেশি দৃশ্যমান। আজকাল হলগুলোতে রুমমেট বা শ্রেণিকক্ষের সহপাঠীরা তার সুপরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নিগৃহীত হতে দেখেও প্রতিকারের জন্য এগিয়ে আসে না। কারো কাছে বলতেও সাহস পায় না। কারণ, নিপীড়নের ভয়। পাছে কী-যে ঘটে, তার ভয় তাদের পেয়ে বসেছে। আজকাল অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক বা সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ করার প্রচেষ্টা অনেক কমে গেছে।
গত বছর রেলের অনিয়মের বিরুদ্ধে ঢাবি ছাত্র মহিউদ্দিন একাই রেল স্টেশনে বসে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন। পাবিপ্রবিতে প্রমোশনের অনিয়ম ঠেকাতে একজন শিক্ষক একাই অনশন করেছেন। দেশ জুড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রফেসর ফরিদউদ্দিন খান একাই লড়ে যাচ্ছেন। তার ভাষ্য হলো ক্যাম্পাসগুলোতে ইদানীং যেসব নৈরাজ্যকর ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে অভিভাবকরা বেশ শঙ্কিত। এসব ঘৃণ্য ঘটনায় কর্তৃপক্ষ শুধু মিটমাট করে দিয়ে ক্ষান্ত থাকে, কোনোরূপ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় বারবার এসব ঘটনা ঘটে চলেছে।
প্রফেসর খানের অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি শুনে আমার স্কুলে হোমওয়ার্ক না করায় হেডস্যারের কানমলা ও ছাত্রকে রাস্তায় বিড়ি খেতে দেখে কাঁচা কঞ্চির বাড়ি দেওয়ার কথা মনে হচ্ছে। হয়তো অনেকে বলতে পারেন, কেন আমি অতীতের কথা নিয়ে ভাবছি। ভাবনার প্রধান কারণ হলো—আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার নামে আমরা চিরায়ত শাসন, স্নেহ-আদর, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার করে দিয়ে শিক্ষাব্যবসা চালু করে শিক্ষাশূন্যতা তৈরি করে ফেলেছি। অতীতে শিক্ষার্থীর পাঠে অমনোযোগিতা বা কোনো অন্যায় আচরণ দেখলে শিক্ষক তাদের শাসন করতেন আবার বেশি শাসন করে শারীরিক কষ্ট দিয়ে নিজেও কাঁদতেন। এখনকার দিনে সেই সুযোগ নেই! আজকাল নেই শাসন, নেই স্নেহ-মমতা দেখানোর পরিস্থিতি। ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে গো’—নামক উক্তিগুলো এখন মৃত। তাই তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করতে এসে একশ্রেণির শিক্ষার্থী গোল্লায় গেলেও কিছু করা যাচ্ছে না।
সারা বছর অবহেলা করে নিয়মিত পড়াশোনা না করে ও প্রযুক্তির অপব্যবহার করে তারা হয়ে উঠছে পাঠবৈরাগ্যে পারঙ্গম একাডেমিক চৌর্যবৃত্তির ধারক-বাহক। অন্য দিকে রুমমেটদের জন্য নির্যাতক, নিপীড়ক এমনকি বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে সহপাঠীদের হন্তারক। এজন্য একবারে নিশ্চুপ না থেকে প্রফেসর ফরিদ খানের মতো বহু মানুষের জেগে ওঠা দরকার।