সবার ছোট ছেলে পৃথিবীতে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার সাজানো গোছানো ছোট্ট একটি পৃথিবী নিজের কক্ষ। সন্তানের সেই কক্ষের সেই পৃথিবীতে বারবার ছুটে যাচ্ছেন ব্যাংকার বাবা মো. জাকারিয়া। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ইশতিয়াক হোসেন প্রান্ত ছিলেন পরিবারের সবার আদুরে। প্রান্তের স্বপ্ন ছিলেন সেনাবাহিনীর মেজর হবেন। সেই মতো বিএমএতে পরীক্ষাও দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট আসার আগেই ঝরনায় বেড়াতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন পরিবারে। বাবা, মা ও ভাইবোনদের অশ্রু সাগরে ভাসিয়ে চলে গেছেন পরপারে। ব্যাংকার বাবা তাকে দাফন করে ফিরে এসে বারবারই ফিরে যাচ্ছেন আদরের প্রান্তের রুমে। তার সাজানো বই, খাতা, টেবিল সবই আছে। কিন্তু শুধু নেই প্রান্ত। সন্তানের স্মৃতি আকড়ে ধরে সময় কাটিয়ে দিচ্ছেন বাবা জনতা ব্যাংকের জিএম জাকারিয়া।
জাকারিয়া বলেন, প্রান্ত খুবই মেধাবী ছিল। সে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে। সেনা অফিসার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিন বন্ধু মিলে ঝরনায় বেড়াতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরবেন তা ভাবতে পারছি না। রাত সাড়ে ১০টায় খবর পাই। এখন সন্তানের কক্ষে তার স্মৃতি আকড়ে বেঁচে আছি।
প্রান্তদের গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপের মুছাপুর হলেও তারা এখন নগরের হালিশহরে বসবাস করেন। বড় মেয়ে এমবিবিএস পাস করে এখন বিসিএস দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় করছেন। তার মেজো ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ইমতিয়াজুর রহমান খান দীপ্ত। দুই সন্তান ঘরে থাকলেও নেই আদুরে ছোট সন্তান প্রান্ত।
২ সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মা
অন্যদিকে বিয়ের ১৭ বছর পর পাওয়া দুই সন্তান হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন নিহত দুই সহোদরের মা কামরুন নাহার। ১৯ জুন মিরসরাইয়ের নাপিত্তাছড়া ঝরনায় মারা যাওয়া দুই সহোদর তানভীর মাহমুদ ও তৌফিক আহমেদের গ্রামের বাড়ি মিরসরাইয়ের পূর্ব আজমনগরে চলছে মাতম। নিহত দুই সহোদরের মা কামরুন নাহারের কান্না থামছে না। বিলাপ করে যাচ্ছে, ‘আমার তৌফিক এনে দাও, আমার তানভীরকে এনে দাও।’
দুই সহোদরের বাবা ওমানের চাকরির সুবাদে চলে গেলে দীর্ঘদিন সন্তান না হলে স্ত্রীকে নিয়ে পাড়ি জমান ওমান। বিয়ের ১৭ বছর পর জন্ম হয় তানভীর আহমেদ। তার ঠিক ৪ বছর জন্ম হয় তৌফিক আহমেদের। দুজনই জন্মগ্রহণ করেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে। ছেলেদের যখন দশ বছর পার হয় তখন দেশে ফিরে আসেন।
চট্টগ্রামে ব্যবসা করে বাড়ি করে শাহাবুদ্দিন ভূঁইয়া ও কামরুন নাহার দম্পতি। বড় ছেলে মাসুদ আহমেদ তানভীরের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে। ছোট ছেলে তৌফিক আহমেদ চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি এ প্লাস পেয়ে পাস করেছেন। ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে।
মা কামরুন নাহার বলেন, কষ্টে পাওয়া দুই সন্তানের একজন ডাক্তার হবে আর একজন ইঞ্জিনিয়ার হবে এই আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। এদিকে নিহত তানভীর ও তারেকের বাবা শাহাবুদ্দিন ৬ বছর আগে ব্রেন স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে প্যারালাইস হয়ে যান। দীর্ঘ চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলেও দুই সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে ঘুরছেন ঘরের রুমে রুমে।
১৯ জুন সকালে চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩ বন্ধু নাপিত্তাছড়া ঝরনায় বেড়াতে যায়। ঝরনায় যাওয়ার পথে স্থানীয় একটি অস্থায়ী খাবারের দোকানে দুপুরের খাবারের ফরমায়েশ দিয়ে যায়। কিন্তু তারা ওই দোকানে আর খেতে আসেনি।সন্ধ্যায় দিকে স্থানীয় লোকজন ঝরনায় ঝিরিতে এক ব্যক্তির মৃতদেহ দেখতে পেয়ে মিরসরাই থানা পুলিশকে খবর দেয়। ঝরনা এলাকা থেকে তিন দিনে ইশতিয়াক (১৯), তানভীরের (২৩) ও তৌফিক আহমেদের (২৩) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস।