অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সমাজে বাস করে না সে হয় দেবতা, না হয় পশু।’ মূলত সমাজে বাস করার ফলে রক্তের সম্পর্কের বাইরেও মানুষ গড়ে তোলে পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও নির্ভরতার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ‘বন্ধু’ শব্দটার মধ্যেই মিশে আছে ক্ষণিকের জীবনে পরমের সান্নিধ্য। সচরাচর বন্ধু বলতে রক্তের বাইরের সম্পর্কের সমবয়সি মানুষের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বোঝায়, যার সঙ্গে ব্যক্তিগত সবকিছুই ভাগ করা যায়। তবে সময় বদলেছে; সেই সঙ্গে বদলেছে বন্ধুত্বের ধারণা। শুধু সমবয়সি নয়, বয়সে বড় কিংবা ছোট কেউও বন্ধু হতে পারে। বাবা-মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না হলে যেমন সন্তানের জীবন অপূর্ণ রয়ে যায়, তেমনিভাবে শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ না হলেও অসম্পূর্ণ রয়ে যায় ‘জীবনের শিক্ষা’। সত্যি বলতে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে দেয় বন্ধুতার স্পর্শ।
এ কথা সত্য, বন্ধুত্বের মধ্যেও রয়েছে ভালোমন্দ উভয় দিক। একজন ভালো বন্ধু যেমন জীবনে অমৃতের স্বাদ এনে দেয়, তেমনি একজন স্বার্থপর বন্ধু জীবনকে করে দিতে পারে নরক! জীবন নদীতে চলার পথে শৈশবে একধরনের বন্ধুত্ব তৈরি হয়, শিক্ষাজীবনে আরেক ধরনের। বলা হয়ে থাকে, শিক্ষার তিনটি ধাপের মধ্যে স্কুলজীবনের বন্ধুত্বই সেরা। সে সময় থাকে না স্বার্থপরতার লেশমাত্র। জীবনকে দেখা যায় নির্মল দৃষ্টিভঙ্গিতে। অন্যদিকে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে দেখা যায় নানা রকমফের!
একবিংশ শতাব্দীর আজকের যুগে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে হতে হচ্ছে অনেক বেশি সতর্ক! এখন বেশির ভাগ মানুষই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। জীবনকে উপভোগ করার চেয়ে তারা জীবনের অর্জনগুলোর দিকে বেশি নজর দিয়ে থাকে। ফলে শুধু স্বার্থের সম্পর্কই তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে। যান্ত্রিক সভ্যতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে মনও হয়ে পড়ছে হতাশা, বিষণ্নতায় পিঞ্জরবন্দি পাখির মতো। উড়তে চাইলেও যেন উড়তে পারা যায় না! জীবনের প্রয়োজনেই মানুষ নিজেকে ব্যস্ত রাখে কর্মক্ষেত্রে; কিন্তু তাই বলে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও! অবশ্য ভল্লুকের গল্পে যেমন দুই বন্ধুর মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, ঠিক তেমন বন্ধু কম নেই আজকের সমাজে! বিশেষ করে বর্তমান তরুণসমাজের দিকে তাকালে এই কথার বাস্তব চিত্র চোখে পড়ে। সুস্থধারার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের অবস্থান একবারে পেছনের কাতারে! তবে ভালো বন্ধুত্বের দৃষ্টান্তও যে একদম নেই, ব্যাপারটা এমন নয়। বন্ধুর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ জীবনকে বাজি ধরার ঘটনাও আছে চারপাশে, যদিও তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম। আসলে বন্ধুত্ব থাকে মনে। একজন ভালো বন্ধুর সঙ্গে বছরের পর বছর দেখা না হলেও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কে মরিচা পড়ে না একটুও। বহু বছর পরও ‘তুই’ করে সম্বোধন করে যাপিত জীবনের কথা বলে ফেলা যায় এক নিঃশ্বাসে। ‘প্রকৃত বন্ধুত্ব’ এটাই।
খেয়াল করলে দেখা যায়, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অভাবে আজকের সমাজে মূল্যবোধহীন নানা ঘটনার অবতারণা হতে দেখা যাচ্ছে। আজকের যে মানসিকতার ধস দেখছি আমরা সমাজের প্রতিটি কোণায়, তা বন্ধুত্বপূর্ণ পবিত্র সম্পর্কের অভাবেই। দাম্পত্য জীবনের কলহ, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ সংঘাত—এসবই সমাজ থেকে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ বিদায় নেওয়ার বিষফল। বলা হয়ে থাকে, ‘সৎ সঙ্গে সর্গ বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এ কথাটি অনেক বেশি করে প্রযোজ্য। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কাকে বন্ধু বানাচ্ছে, এসব বিষয়ে খেয়াল রাখা আজকের দিনে বাবা-মায়ের জন্য অতি বেশি জরুরি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে সচেতনভাবে—এ কথাটি আমরা যেন ভুলে না যাই। সব সময় মনে রাখতে হবে, ভালো বন্ধু ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। ভালো বন্ধুর অভাব জীবনকে হতাশা, বিষণ্ণতা, একাকিত্বের দিকে ঠেলে দেয়। আর এই একাকিত্ব ক্রমাগতভাবে জীবনকে নিয়ে যায় আত্মহত্যার দিকে! সুতরাং, বন্ধু থাকুক কাছে, হাজার কাজের মধ্যেও।