আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ চায় আওয়ামী লীগ। তবে তাদের জোর করে ভোটে আনার কোনো পরিকল্পনা নেই। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, কূটনীতিক কিংবা রাজনীতিকদের সঙ্গে যেকোনো আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দিচ্ছেন। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিএনপির দাবি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই অবস্থায় নির্বাচনি বছরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে পারে। যদিও সম্ভাব্য সব নাশকতা প্রতিহত করতে ঘোষণা দিয়ে মাঠে রয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তারা মাঠে থাকবে এবং নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হলে তা কঠোরভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নির্বাচনি প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া ভোটগ্রহণ সম্ভব নয়।’ রবিবার সকালে পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প আয়োজিত ‘নির্বাচনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের চ্যালেঞ্জসমূহ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে বোঝাপড়ায় ফাঁক থাকলে, নির্বাচনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে, সেই নির্বাচন প্রত্যাশিত মাত্রায় অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে না। সেই নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে যদি কোনো বোঝাপড়ার গ্যাপ থাকে, তাহলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করুন। সবার সহযোগিতায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে জনগণের কাছে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে চেষ্টা করব।’ সিইসি বলেন, ‘ইভিএমের ভালো দিক হলো নিরাপত্তা। ভোটারের ফিঙ্গার প্রিন্ট না মিললে ডিজিটাল ব্যালট ওপেন হবে না। কিন্তু আমাদের বড় একটা অংশ দাঁড়িয়ে গেলেন ইভিএমের বিপক্ষে। তারা অনর্গল বলতে লাগলেন যে এটা ভোট চুরির মেশিন। আমি নির্বাচন কমিশনে প্রথম যখন আসি, তখন আমিও বিশ্বাস করলাম এটা মনে হয় ভোট চুরির মেশিন। এরপর দীর্ঘদিন এটি পরীক্ষা করি। বিশেষজ্ঞ নিয়ে এসে তাদের মেশিন দিয়ে বললাম, আমাদের দেখিয়ে দেন কারচুপিটা কীভাবে করা সম্ভব। কিন্তু তারা দেখাতে পারেননি। গত ৯-১০ মাসের নির্বাচনগুলোতে কোনো বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগ পাইনি। আবার বলা হলো, শেষের ১০ মিনিটে ফলাফল পালটে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ১০ মিনিটে যদি এক ডজন আইনস্টাইনকেও বসিয়ে দেওয়া হয়, তারাও ফলাফল পালটাতে পারবে না। এটা সম্ভব না।’ কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনের আন্তরিকতা দরকার। ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারছেন, সেই পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব কিন্তু জেলা প্রশাসনের, পুলিশ প্রশাসনের।’
নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র মেনে নেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর হবে না, হবে না, হবে না, ইনশাআল্লাহ হবে না। নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে। আর এই নির্বাচন হতে দেবেন না—এমনটা হলে খবর আছে। নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করলে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে।’ রবিবার বিকালে ঢাকার কেরানীগঞ্জে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নির্বাচনে বিএনপিকে জোর করে আনা হবে না। তবে আগামীতে বিএনপি নির্বাচনে না এলে দলটি আইসিইউতে যাবে। তাদের আন্দোলনের গতি কমছে আর অভিযোগের পাহাড় বাড়ছে।’ এ সময় বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর আন্দোলনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আপনাদের পল্টন থেকে গোলাপবাগে যাওয়া ভুয়া, গরুর হাটের আন্দোলন ভুয়া, ২৭, ১২, ১০ দফা সবই ভুয়া।’ ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে হটানো সম্ভব নয়। ১৯৭৫ আর ২০২৩ সাল এক নয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক অস্বাভাবিক সরকার বাংলাদেশে আর হবে না।’ বিএনপির মহাসচিবের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা সংকটে আছেন। আপনাদের দিয়ে কোনো আন্দোলন হবে না। আপনাদের দলও ভাঙব না, জোটও ভাঙব না, তবু তাসের ঘরের মতো সব ভেঙে যাবে। আপনাদের জোট টিকবে না, টিকতে পারেও না।’ ওবায়দুল কাদের বলেন, মাঝে মাঝে ভাবতে কষ্ট হয়—এই দলও (বিএনপি) আবার ক্ষমতা চায়। এ দেশে হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়া কঠিন। শেখ হাসিনার সরকারকে হটাতে বিএনপি এখন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ রোহিঙ্গা শিবির নিয়ে চক্রান্ত করছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিএনপির খেলার দম ফুরিয়ে গেছে। আমরা আন্দোলনেও খেলব, নির্বাচনেও খেলব। বিএনপি এখন খরার কবলে। খরার মধ্যে পড়েছে বিএনপি। অসুস্থ হয়ে অচিরেই হাসপাতালে যাবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে কোনো নির্বাচন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার না আসছে। আগামী নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। দেশের মানুষ জেগে উঠেছে। এই মুহূর্তে সবাই চায় এই সরকারের পরিবর্তন। ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে রাজপথে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটা গণবিপ্লব করে এদের পরাজিত করতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। এই সরকারের সঙ্গে রাজপথেই ফায়সালা হবে। আমরা ঐক্যবদ্ধ, ইতিমধ্যে রাজপথে নেমেছি। গতকাল রবিবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় তিনি এ কথা বলেন। ২০০৯ সালে পিলখানায় শহিদদের স্মরণে বিএনপি এই আলোচনাসভার আয়োজন করে। বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর সঞ্চালনায় আরো বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান প্রমুখ। মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এবার আর দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। এর জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী থাকবে। আমরা পদযাত্রা করি, তারা পাশে শান্তিযাত্রা করে। তাদের শান্তি কমিটির সঙ্গে বিএনপির এমন যুদ্ধ লাগবে, এতেই তাদের কেল্লাফতে হয়ে যাবে। এই যে গৃহযুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে, এর জন্য দায়ী থাকবে আওয়ামী লীগ সরকার। এদিকে গতকাল বিকালে নবাবগঞ্জে ঢাকা জেলা বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি-পূর্ব সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যে কোনো মূল্যে সরকারকে ঠেকাতে হবে। সরকার মানুষকে মামলা দিয়ে আন্দোলন ঠেকিয়ে রাখতে চায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দিয়ে বেআইনিভাবে তারা আবার ক্ষমতায় আসতে চায়। এ দেশের জনগণ আর আপনাদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা চাই বিএনপিসহ সমস্ত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক এবং জনগণ উত্সাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভোট দিয়ে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আগামীর সরকার নির্বাচিত করুক। সরকারের পক্ষ থেকে যদি কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন থাকে, সেটি অবশ্যই আমরা করব।’ রবিবার দুপুরে মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনে আগত দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরামে’র প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। ড. হাছান বলেন, ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ১০৮টি সংগঠন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। তার মধ্যে ৫১টি সংগঠনের মোর্চা হচ্ছে ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম। তারা আমার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। তারাও বলেছে, তারা চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সমস্ত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, যেখানে জনগণ উত্সাহ নিয়ে আগামী দিনের সরকার নির্বাচিত করবে। এই ফোরাম গত নির্বাচনও মনিটর করেছে, আগামী নির্বাচনেও তারা ইলেকশন মনিটরিং দল পাঠাবে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে।