সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে কয়েক দিনে ২৮ জনের মৃত্যু
►৫৬ হাজার হেক্টর জমির আউশ ক্ষতিগ্রস্ত
►জকিগঞ্জের আরো এলাকা প্লাবিত
► হবিগঞ্জে পাঁচ হাজার গরুর খামারি বিপাকে
► নেত্রকোনায় ত্রাণের প্যাকেট জব্দ, চুরির অভিযোগ
সিলেটের সবচেয়ে বন্যাকবলিত কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটে পানি কমতির দিকে। গোয়াইনঘাটে পানি নামছে ধীরে। বিয়ানীবাজার ও বিশ্বনাথ উপজেলায় পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। কুশিয়ারায় পানি বাড়ায় আরো প্লাবিত জকিগঞ্জ।
এ ছাড়া মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরের অনেক এলাকা বন্যাকবলিত। কোথাও কোথাও পানি বাড়ছে। দুর্গত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে।
কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, এবারের বন্যায় এখন পর্যন্ত দেশের ৫৬ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। কৃষিমন্ত্রী বলেন, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে ২২ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন বন্যা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, মৌলভীবাজারসহ অনেক জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৫৬ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া শাক-সবজি, তিল, বাদাম প্রভৃতি ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ বন্যার কারণে দেশে খাদ্যসংকট হবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
গত কয়েক দিনে বন্যার পানিতে ডুবে, বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে, বজ াঘাতে ও টিলা ধসে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আগের দিন পর্যন্ত ২৩ জন এবং গতকাল জৈন্তাপুরে মা ও ছেলে এবং শান্তিগঞ্জে আরো তিনজনের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যুর খবর কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হিমাংশু লাল রায়।
সিলেটের সবচেয়ে দূরবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জের পৌরসভা ছাড়া ৯টি ইউনিয়নের সব প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত এসব স্থানে কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর সমান পানি ছিল। বারহাল ইউনিয়ন ও সুলতানপুর ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি বেশি খারাপ। গ্রামের অভ্যন্তরের সড়কগুলো পানিতে ডুবে গেছে। অন্তত পাঁচ জায়গায় জকিগঞ্জ-সিলেট মহাসড়ক ডুবে গেছে। ফলে বাস ও ট্রাক ছাড়া আর কোনো যানবাহন এ সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারছে না। উপজেলায় ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সব কটিতেই লোকজন উঠেছে।
জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফয়সাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তিন দিন ধরেই অল্প অল্প করে পানি বাড়ছে। গতকাল সারা দিন রোদ থাকলেও ঢলের কারণে পানি বেড়েছে। উপজেলার ৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২০১টি পরিবারের ৮২১ জন আশ্রয় নিয়েছে। আমরা ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছি। ইউনিয়নগুলোতে তিন টন করে চাল ত্রাণ বরাদ্দ করা হয়েছে। ’
জকিগঞ্জে পানি কমার দিকে থাকায় দ্রুত বাড়ি ফেরার আশা করছে এসব এলাকার মানুষ। পানিতে তলিয়ে যাওয়া উপজেলা কমপ্লেক্স, থানা ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখনো হাঁটু সমান পানি। গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়ন থেকে পানি নেমে গেলেও বাকিগুলোতে এখনো পানি রয়েছে। তবে এর মধ্যে ডৌবাড়ী ইউনিয়নের হাটগ্রাম, নগর ডেংরিসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে পানি ভিটার নিচে নেমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে এসব গ্রামে মানুষ বাড়িঘরে ফিরে গেছে।
হাটগ্রামের বাসিন্দা ও এমসি কলেজের শিক্ষার্থী নুরুজ্জামান রায়হান বলে, ‘আমাদের গ্রাম ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামে পানি ঘর থেকে নেমে যাওয়ায় অনেকে ফিরে আসছে। ’
সুনামগঞ্জ শহরতলির আশপাশে দুর্গতদের ত্রাণ, খাবার পানি, চিকিৎসা, ওষুধ সহায়তা ও রান্না করা খাবার দিয়ে যাচ্ছে সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবি। তবে দুর্যোগের কারণে বিচ্ছিন্ন হওয়া সড়কপথে মালপত্র না আসায় নিত্যপণ্যের মূল্য এখন আকাশছোঁয়া। এই সুযোগে নৌপথে বিভিন্ন স্থান থেকে নিত্যপণ্য এনে উচ্চ দামে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এই অভিযোগে জেলা প্রশাসন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এখনো আমাদের বিদ্যুৎ, যোগাযোগ বন্ধ। শহরের একটি অংশের কিছু স্থানে সামান্য বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। সব জায়গায় চালু করতে সময় লাগবে। ’ তিনি আরো বলেন, এখন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ডসহ জেলা প্রশাসন ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে। আমরা ৪৫০ আশ্রয়কেন্দ্রে এক লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ স্যালাইন দিচ্ছি। ’
হবিগঞ্জের ছয়টি উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত। জেলার ১৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ১৩ হাজার ২৮৯টি পরিবার। সরকারিভাবে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৫।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পৌরসভাসহ সব ইউনিয়ন, নবীগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন, বানিয়াচং উপজেলার সব ইউনিয়ন, লাখাই উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন এবং বাহুবল উপজেলার একটি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। সরকারিভাবে গতকাল পর্যন্ত ১০ লাখ টাকা, ১৪৫ মেট্রিক টন চাল এবং দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২৯টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, বন্যায় জেলার দুই হাজার ৫৫৩টি পুকুর ডুবে মাছ ভেসে গেছে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাস জানান, বন্যার কারণে জেলার পাঁচ হাজার গরুর খামার মালিকের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ছে। এতে শেরপুর এলাকা, খলিলপুর, মনুমুখ, আখাইলকুড়া ইউনিয়নের বন্যাদুর্গত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। বোরো ধান, গৃহপালিত গবাদি পশু, শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে আর বসতবাড়িতে থাকা যাচ্ছে না। তাই দুর্গতরা আত্মীয়-স্বজনের বাসাবাড়ি বা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় উঠেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শামছুদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, বন্যায় মৌলভীবাজার জেলার সাতটি উপজেলায় ১১ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১০১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে নারী, পুরুষ ও শিশু মিলে ২৪ হাজার। মেডিক্যাল টিমের ৬০ জন মাঠে নিয়োজিত। জেলার সাতটি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা চার লাখ। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা দুই লাখ ২০ হাজার। এক হাজার ৩০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২১০ মেট্রিক টন চাল ও এক হাজার ৭০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিলি করা হয়েছে।
নেত্রকোনার বন্যার পানি ধীরে কমছে। তবে ১০টি উপজেলার ৮৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬২টিতে এখনো কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি। জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার ইউএনও এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বলেন, গতকাল রাত থেকে পানি কিছুটা কমছে। তবে উপজেলার প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা এখনো পানির নিচে। মদনের গোবিন্দশ্রী, ফতেপুর, তিয়শ্রী, নায়েকপুর, মোহনগঞ্জের তেঁতুলিয়া, বরান্তরসহ দুই উপজেলার ৮৫ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে আছে।
দুপুরে নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পাশের বাজারের একটি দোকান থেকে ত্রাণের প্যাকেট জব্দ করেছে পুলিশ। জব্দ করা পাঁচটি বস্তায় মোট ১৬টি প্যাকেট। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, মেন্দিপুর ইউপির চেয়ারম্যান আবু হানিফের ভাষ্য মতে, বিতরণের জন্য সোমবার সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে ত্রাণের প্যাকেট রাখা হয়। কিন্তু সেখান থেকে ১৬ জনের খাবার একটি দোকানে চুরির উদ্দেশ্যে পাচার করা হয়। তবে কে বা কারা পাচার করেছে তা চেয়ারম্যানের জানা নেই।
কিশোরগঞ্জে গতকাল নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়। শুধু নিম্নাঞ্চল নয়, উঁচু এলাকাগুলোতেও পানি উঠছে। গত তিন দিনে জেলার ৯টি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়। ২৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১২ হাজার ৭৪৮ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। এ ছাড়া ৯ উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রামের আটকে যাওয়া পরিবারগুলোও খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাবে কষ্ট করছে। এদিকে তলিয়ে যাওয়ায় ইটনা ও করিমগঞ্জ উপজেলার ১৫টি গ্রামের বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কর্তৃপক্ষ।
সরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা চালানো হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে জানিয়েছে দুর্গত লোকজন। তারা বলছে, আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ তৎপরতা বেশি। ঘরে আটকেপড়া মানুষ ত্রাণ কম পাচ্ছে।
জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার দড়িগাংগাটিয়া গ্রামের রেখা বেগম কয়েক দিন ধরে বৃদ্ধ স্বামী, দুই ছেলে, ছেলেদের বউ, নাতি-নাতনিদের নিয়ে ঘরে পানিবন্দি। তিনি বলেন, ‘ঘরে যা খাবার ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। এখন ঘরের সবাই অভুক্ত অবস্থায়। কেউ এখন পর্যন্ত খবর নেয়নি, সহযোগিতা করেনি। ’
জেলা প্রশাসক মো. শামীম আলম বলেন, শুধু আশ্রয়কেন্দ্রকেন্দ্রিক নয়, সবখানে সরকারের বরাদ্দের ভিত্তিতে ত্রাণ তৎপরতা চলছে। আরো বরাদ্দ আসবে। সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভব সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
শেরপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সদর উপজেলার চরপক্ষিমারী ইউনিয়নের কুলুরচর-বেপারীপাড়ার ব্রহ্মপুত্র নদের চরে বসবাসকারী অনেক বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। পানি বেড়েছে দশানি ও মৃগী নদীতে। এতে বন্যার আশঙ্কা করছে নদী-তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা।
এদিকে পাহাড়ি ঢলের পানি নামতে থাকায় নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার পানি উজান থেকে কমলেও নিম্নাঞ্চলের অনেক গ্রামে এখনো পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দি। ঝিনাইগাতীর বন্যাকবলিত সারি কালীনগর ও দড়ি তালিনগর এলাকায় গতকাল বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ভলান্টিয়ার্স ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ২০০ মানুষকে শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে।