সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চলছে বহুমুখী অস্থিরতা। করোনা মহামারির পর বিশ্ব অর্থনীতি যখন একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, ঠিক তখনই দেশে দেশে অর্থনীতিতে শুরু হয় অচলাবস্থা! জলবায়ুর অভিঘাতে বিশ্ব ডুবছিল অনেক আগে থেকেই। এর সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। বিশেষ করে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনীতিতে লাগে এর জোর ধাক্কা। এরপর সময় যত গড়াতে থাকে, বিশ্ব অর্থনীতিতে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে স্থবিরতা। ক্রান্তিকাল এখনো কাটেনি, বরং মহাসংকট ধেয়ে আসছে বলেই মনে হচ্ছে!
কোভিড মহামারি, বিরূপ জলবায়ু, যুদ্ধ—বিশ্ব অর্থনীতিকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে মোটা দাগে এ তিনটি ইস্যু। পুরো বিশ্বের অবস্থায় এখন কাহিল! তবে এশিয়ার অবস্থা একটু বেশিই করুণ। এই অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে সম্পদবঞ্চিত তথা, অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে। তাই বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার ধাক্কা এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনীতিকে স্থবির করে দিয়েছে এক নিমেষেই। দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের অর্থনীতি বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিল বিগত কয়েক দশকে। ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার’ লক্ষ করা যাচ্ছিল প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতিতে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে! তবে এসবের মধ্যে ছোট আয়তনের বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো আছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার কারণে বিশ্বের বড় বড় দেশ যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি সুবিধাজনক অবস্থান ধরে রেখেছে—এ কথা বলতেই হয়। যদিও দেশটির অর্থনৈতিক কাঠামোগত ত্রুটিগুলোকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে!
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে রয়েছে—এমন কথা বলা যায় না। এমন দাবি নিতান্তই অযৌক্তিক হবে। তবে কিছুটা স্থবিরতা যে নেই, তা-ও বলা যায় না। চলমান বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুর ঘাতপ্রতিঘাতে কোন দেশের অর্থনীতি কখন প্রতিকূল অবস্থায় নিপতিত হয়, তা বলা মুশকিল। উপরন্তু এ বছর মন্দা আসতে পারে বলে বিভিন্ন মহল থেকে জোর আশঙ্কাও রয়েছে। এ অবস্থায় আসন্ন যে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। বিভিন্ন খাতে সতর্কতা অবলম্বন করার মাধ্যমে অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি ঘটাতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এ রকম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও সমসাময়িক খাত নিয়েই এ আলোচনা—
এক. বাংলাদেশের রপ্তানি আয় অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তৈরি পোশাক (আরএমজি)। আরএমজি খাতে বাংলাদেশ ভালো করছে বটে, কিন্তু কিছু বিষয়ে নজর দিতে পারলে এ খাত থেকে আরো সুফল পাওয়া যাবে। চলমান বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এ শিল্প বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। জ্বালানিসংকটের কারণে উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার ফলে এক প্রকার সংকট চলছে আরএমজি খাতে। তাছাড়া এ খাতে রয়েছে অবকাঠামোগত দুর্বলতা। এসবের সঙ্গে রয়েছে মানব শ্রমের ওপর অতি নির্ভরতা। দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য উদ্যোক্তা ও সরকারকে এসব বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে আমলে নিতে হবে।
দুই. বাংলাদেশের কর সংস্থা নানা সমস্যায় জর্জরিত। কর আদায়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র অচেনা নয়। আয় বাড়াতে কর আদায়ের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্রুটিও লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি, কর সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু যেহেতু কর ফাঁকির প্রবণতা অনেক বেশি বেড়ে গেছে, সেহেতু কর আদায়ে সময়োপযোগী-কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। বিগত বছরগুলোতে কর আদায়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি সরকার। অনুন্নত পরিবহনব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া—এ ধরনের নানা অজুহাতের কারণে কর আদায়ে হিমশিম খেতে হয় কর কর্তৃপক্ষকে। এর ফলে সরকারের আয় কমে যাচ্ছে ক্রমাগতভাবে। সরকারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব বিষয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে যারা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, তাদেরকে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
তিন. সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে রেমিট্যান্স-প্রবাহ অনেকটা কমে গেছে। যদিও কোনো কোনো মাসে রেমিট্যান্স-প্রবাহ স্বাভাবিক থাকতে দেখা যাচ্ছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হওয়ায়, তথা বৈশ্বিক সংকট চলমান থাকায় সামনের দিনগুলোতে এ প্রবাহ স্বাভাবিক থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিষয়টি সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে নজর দিতে হবে বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য হ্রাসের দিকে। ডলারের দাপটে বাংলাদেশি মুদ্রা, তথা টাকার মূল্য ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা থেকে নিষ্কৃতি পেতে জুঁতসই ব্যবস্থার অবতারণা করা যায় কীভাবে, তা ভাবতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সমাজের সার্বিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ বিষয়ে নজর দেওয়া অতি জরুরি।
চার. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা সমুন্নত রাখতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই জ্বালানি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এ খাতে কীভাবে প্রযুক্তির উন্নতি ঘটানো যায়, তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেখতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদনকে বিশ্ব এখন ব্যাপক প্রাধান্য দিচ্ছে। এটা সময়েরও দাবি। কাজেই বাংলাদেশকেও সে পথে হাঁটতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন কমে গিয়ে বিশ্বব্যাপী যে হারে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে এবং এর ফলে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের মূল্য যে মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে করে ভবিষ্যতে জ্বালানি সুরক্ষার বিষয়ে এখন থেকেই মনোযোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগামীর বিশ্ব মানেই ‘জ্বালানি সক্ষমতা’।
পাঁচ. তৃণমূল পর্যায়ে বাংলাদেশ বেশকিছু উন্নয়ন সাধন করেছে। আর্থসামাজিক অবকাঠামোর উন্নতি একটি দেশের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয় বটে, তবে তা হতে হবে ‘সুষম’। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, আগামী বছরগুলোতে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে অবকাঠামো খাতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ধরে রাখতে হবে।
ছয়. ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত গতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি নিকট ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়তে পারে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সও বলছে একই কথা। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, চরম আবহাওয়ার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের ১ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। সঠিক ও পর্যাপ্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে না পারলে এর প্রভাব পড়তে পারে শহরাঞ্চলেও। টেকসইব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ সমস্যা আরো খারাপ আকার ধারণ করতে পারে। এর ফলে শহরাঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিও প্রবল। তাছাড়া মন্থর উন্নয়ন প্রকল্প, ক্রমবর্ধমান শহুরে দারিদ্র্য এবং বায়ু ও পানিদূষণের মতো সমস্যাগুলোর সমাধানেও দ্রুত ভিত্তিতে মনোযোগ দেওয়া দরকার।
সাত. ‘আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি’ যে কোনো দেশের জন্যই মাথাব্যথার বড় কারণ। বাংলাদেশকেও এ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কমবেশি। এক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে।
সত্যি বলতে, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন পর্যন্ত খারাপ বলে মনে হয় না। তবে সতর্কতা অবলম্বন না করলে বিপদ আসতে কতক্ষণ! শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান কেবল অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেই ব্যর্থ হয়নি, বরং বিদেশি বাণিজ্যিক ঋণের ভার চেপে বসেছিল দেশ দুইটির সরকারের ঘাড়ে। তাছাড়া ঋণসেবার বাধ্যবাধকতার ভার বহন করতে গিয়েও নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে এসব দেশকে। সে তুলনায় জিডিপির সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের অনুপাত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশিত হারের চেয়ে অস্বাভাবিক নয়। আন্তর্জাতিক ঋণের অবস্থানের প্রশ্নে এ নিয়ে কোনো উদ্বেগের কারণ নেই। তবে ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশে জিডিপি মন্দার প্রাথমিক সতর্কতা সংকেত দেখাতে শুরু করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে আইএমএফ। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে বটে, কিন্তু আইএমএফের শর্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারলে বিপদে পড়ে যাওয়াটা অমূলক চিন্তা নয়। তাই অর্থনৈতিক কাঠামোর সংস্কারের প্রশ্নে বাংলাদেশকে ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে। করোনা মহামারির অভিঘাতে বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনৈতির ধাক্কা যেভাবে আছড়ে পড়ে প্রতিটি দেশে, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হলে নানা সমস্যা আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরবে বিশ্ব অর্থনীতির আগামী দিনের পথচলাকে। এমতাবস্থায়, অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশকে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। এতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ সুগম হবে, নিশ্চিত করা যাবে টেকসই উন্নয়ন।