এক লোক এতই কৃপণ ছিল যে, সে খরচ বাঁচাতে বউকে রেখে একা হানিমুন করতে গিয়েছিল। কৃপণ ব্যক্তিদের নিয়ে আমাদের সমাজে এমন অনেক কৌতুক চালু আছে। আসলে সম্পদ থাকা সত্ত্বেও চাহিদানুযায়ী ব্যয় না করাকে কৃপণতা বলে। কৃপণ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ব্যয়কুণ্ঠ বা অত্যন্ত সঞ্চয়প্রিয়, অনুদার, কঞ্জুস, কিপটে ইত্যাদি। এটি একটি নিকৃষ্ট স্বভাব, যা ব্যক্তিকে তুচ্ছ করে। কৃপণতার কারণে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয় এবং কৃপণকে কেউ ভালো চোখে দেখে না। কৃপণতা করে সম্পদ জমা করলেও এর মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।
মানুষ কখনোই একই সঙ্গে দয়ালু ও কৃপণ হতে পারে না। কেননা দুটোই হলো একই মুদ্রার দুটো পিঠ। কৃপণতাকে ছোটলোকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ছোটলোক মানে ছোট আকারের মানুষ নয়, ছোট মনের মানুষ। ছোট মনের মানুষ নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত। মহানবী (সা.) বলেছেন, কৃপণ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। অনেকে বোঝে না যে কৃপণ কাকে বলে। বাংলাদেশে নিজ দৃষ্টিকোণ থেকেই মানুষ একে অপরকে কৃপণ আখ্যা দেয়। অনেক সময় লোভী ও অপব্যয়কারী ব্যক্তিরা মিতব্যয়ী বা হিসাবি মানুষকে কৃপণ বলে দোষারোপ করে। অভাবী বা ঋণগ্রস্ত মানুষকেও বাইরের লোকেরা কৃপণ আখ্যা দেয়।
তবে কৃপণতা সব সময় খারাপ নয়। ধরা যাক, বাংলাদেশের কোনো একজন বোলার প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বল করছেন। তখন কিন্তু বলা হয়, বোলার রান দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন কৃপণ হন। আবার বাজেট অধিবেশনে আমরা বলতে শুনি, শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে কৃপণতা করা চলবে না। বৃষ্টি কম হলে আমরা বলি, বর্ষাকাল এবার কৃপণতা করছে। দান-অনুদানের ক্ষেত্রেও আমরা কৃপণতা না করার পরামর্শ দিই। কৃপণতার ভালোমন্দ নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।
এখন যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তুলনায় যেভাবে আয় কমছে, তাতে মানুষ এমনিতেই কৃপণ হয়ে যাচ্ছে। কৃপণতা ছাড়া বর্তমান জমানায় টিকে থাকা দায়। প্রতি বছর আমরা মনে করি, সামনের বছর পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সুদিন আসবে। জিনিসিপত্রের দাম কমবে। আয় বাড়বে। কিন্তু আমাদের সে আশা পূরণ হয় না। এবার বন্যা তো পরের বছর খরা। এ বছর মহামারি তো পরের বছর যুদ্ধ। একটা না একটা ফ্যাসাদ লেগেই থাকে। আর সবকিছুর চাপ পড়ে মানুষের আয়ে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেট্রোরেলের গতিতে এগিয়ে যায়। আর আয় বাড়ে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নের মতো। কখনো তা দেখা যায়। কখনো দেখা যায় না। কখনো নষ্ট হওয়া বাসের মতো থেমে থাকে।
কাজেই কৃপণতা বা ভদ্র ভাষায় ব্যয়-সংকোচন এখন টিকে থাকার অনিবার্য শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে অনেক মনীষী কৃপণতাকে ভবিষ্যৎ জীবনের সোপান হিসেবে চিহ্নিত করছেন। তাদের মতে, আজকের কৃপণ আগামী দিনের সুখী ও সমৃদ্ধিশালী জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
অনেকে কৃপণ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টিপসও দিচ্ছেন। যেমন : একজন বলেছেন, কৃপণ হওয়ার পূর্বশর্ত বাজার না করা। যদিও কদাচিৎ বাজারে যান; তেল, আলু-পেঁয়াজ, মাছ-মাংস ২৫০ গ্রামের বেশি কিনবেন না। দেখবেন এক সপ্তাহেই পুরো এলাকায় আপনার কৃপণ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।
একই জামা বছরের পর বছর পরতে থাকুন। সুতির পরিবর্তে পলেস্টার কাপড় পরুন। যেন কেউ বুঝতেই না পারে জন্মলগ্নে আসলেই জামাটির প্রকৃত রং কী ছিল!
বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনুন। কোনো বন্ধু কখনো কিছু খাওয়ালে তারপর থেকে তার ছায়াটিও এড়িয়ে চলুন! নিজে ফাউ খাবেন, কিন্তু মরলেও অন্যকে খাওয়াবেন না, এই নীতি মেনে এগিয়ে চলুন। দেখবেন, বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বাবুই পাখির মতো হ্রাস পেয়েছে।
বয়স যতই বাড়ুক; বিয়ে-শাদি থেকে দূরে থাকুন। নিজে কামাই-রোজকার করে অন্য বাড়ির মানুষ এনে খাওয়াবেন—এমন ভুল জীবনেও করবেন না! তাছাড়া বর্তমান বাজারে একজনের আয় দিয়ে একাধিক মানুষের ভরণপোষণ একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানবাহন ব্যবহার ছেড়ে দিন। হাঁটার অভ্যাস করুন। হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য যেমন উপকারী, একই সঙ্গে এতে কোনো খরচাও নেই। অ্যাক্সিডেন্টের ভয় নেই। তবে এতে জুতা বা সেন্ডেলের ওপর একটু বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। সেক্ষেত্রে কম দামে জুতা বানিয়ে নিন। এগুলো তুলনামূলকভাবে যেমন সস্তা, আবার টেকসইও হয়। এমন দোকান বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে। খোঁজ নিলে সহজেই পেয়ে যাবেন। উল্লিখিত টিপসগুলো ছাড়াও কৃপণ হতে স্থান-কাল-পাত্রভেদে আরও অনেক সুচিন্তিত ও গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে সমাজে একজন ডাকসাঁইটে ‘কৃপণ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হবে। তাহলেই আপনি ঠিকঠাকমতো টিকে থাকতে পারবেন।
কৃপণদের নিয়ে আমাদের সমাজে রয়েছে নানা গল্প। তেমন একটি জনপ্রিয় গল্প হলো, এক কৃপণ ব্যক্তি ৫০ টাকার বিনিময়ে একটি লুঙ্গি কেনে। বেশ কিছুদিন ব্যবহারের পর এটি কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে যায়। ব্যবহার অনুপযোগী দেখে সে ভালো অংশটুকু কেটে গামছা বানিয়ে নেয়। কিছুদিন গামছা হিসেবে ব্যবহারের পর তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে উঠলে ভালো অংশটুকু কেটে রুমাল তৈরি করে। রুমাল হিসেবে কাপড়ের টুকরাটি ব্যবহারের কিছুদিন পর তা নষ্ট হয়ে গেলে কাপড়ের টুকরাটি আগুনে পুড়ে ছাই তৈরি করে। অতঃপর সে ছাই দিয়ে দাঁত মেজে নদীর পানিতে কুলি করতে করতে বলে, ‘যা শালা! আমার ৫০টা টাকাই জলে গেল।’
কৃপণ দুই ভাই বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একটি দোকান চালাচ্ছিল। রাতে তারা পালাক্রমে দোকানটিতে থাকত। একদিন বড় ভাই বাসায় যাওয়ার সময় অর্ধেকেরও বেশি পথ অতিক্রম করার পর মনে হলো, আজ সে ছোট ভাইকে ঠিক সময়ে বাতি নেভানোর কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল। তাই সে আবার রওনা দেয় দোকানের দিকে। কারণ ছোট ভাই যদি ভুলে বাতি না নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তবে অনেক টাকার কেরোসিন জ্বলে যাবে এবং বেশ ক্ষতি হবে। কিন্তু সে দোকানে এসে দেখে ছোট ভাই বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার পরও সে ভাইকে ডেকে তোলে এবং বলে সে কী কারণে এসেছে! ছোট ভাই জবাবে বলে, আমি এত বোকা নাকি? তুমি না বললেও আমি ঠিক টাইমে বাতি নিভিয়েছি। দুইটা টাকা বেশি খরচ হোক, আমি তা চাই না। বরং এই ফালতু কথা বলার জন্য যে তুমি এত দূর থেকে আবার হেঁটে এসেছ এর ফলে জুতার তলদেশ ক্ষয় হয়ে জুতার আয়ু কমে গেল না? এতে তো তোমার কিছু টাকা ক্ষতি হয়ে গেল।
এবার বড় ভাই একগাল হেসে জবাব দেয়, তা হবে না। আমিও চালাকি করে জুতার তলদেশ ক্ষয় না হওয়ার জন্য জুতাগুলো বগলদাবা করেই এনেছি। এই দেখ। বলেই সে জুতা জোড়া বগলের নিচ হতে বের করে দেখায়।
‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যাওয়া এক ব্যক্তি আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। ভদ্রলোকের অর্থ ও প্রতিপত্তির কোনো শেষ নেই। কিন্তু কোথাও কোনো সমাজকল্যাণমূলক কাজে এক পয়সাও দান করেন না।
একবার কাছাকাছি একটা ক্লাবের ছেলেপুলেরা ভাবল, ওনাকে গিয়ে ধরবে। ক্লাবের ব্যাডমিন্টন মাঠটা পরিচর্যা করবার জন্য কিছু টাকা আদায় করবে। সেইমতো একদিন তারা গেল ঐ ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ি।
ভদ্রলোক বাইরে আসতেই ক্লাবের একটি ছেলে বলল, ‘স্যার, আপনার তো বিশাল নামডাক। অনেক প্রতিপত্তি শুনেছি। আমরা একটু এলাম, আমাদের ক্লাবে কিছু টাকা চাঁদা দেন যদি, ভালো হয়।’
ধনাঢ্য ভদ্রলোক একটুও বিচলিত না হয়ে বললেন, ‘তোমরা শুধু বাইরেরটাই দেখো। ভেতরের খবর কিছু তো জানো না। জানো, আমার একমাত্র ভাই, ক্যানসারে শয্যাশায়ী। প্রতি সপ্তাহে তার চিকিৎসার খরচ ৩ লাখ টাকা। জানো তোমরা?’
ক্লাবের ছেলেরা একটু হকচকিয়ে গেল। বাস্তবিকই তারা এত খবর জানত না। তবু একজন আমতা-আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, ভদ্রলোক আরও খাদে গলা নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘কী আর বলব তোমাদের। আমার দুলাভাই। দুই বছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর থেকে ওদের সংসার দেখার মতোই কেউ নেই। আপার একটা ছেলে আছে বারো বছরের, একটা মেয়ে আট বছরের। বলতে গেলে একরকম অনাথ ওরা আজ। কে আছে ওদের আমি ছাড়া? তারপর আমার নিজের শ্বশুর। পুরো প্যারালাইসড। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। তার চিকিৎসার জন্য লাগে লাখ লাখ টাকা।’
ছেলেরা মানে মানে সরে যেতে পারলে তখন বাঁচে। কিন্তু ভদ্রলোক আরও বলছিলেন, ‘আমার মেজো ফুপু। দুটি কিডনিই তার অকেজো। কত টাকা যে পানির মতো খরচ হয় ওনার চিকিৎসায়। অতি কষ্টে বেঁচে আছেন তিনি। খবর রাখো এসবের?’
ছেলেদের লিডার এবার বলল, ‘ঠিক আছে, স্যার আমরা সত্যিই এতকিছু জানতাম না। ঠিক আছে, আমরা তাহলে আসি আজকে।’
‘হ্যাঁ, যাও যাও।’ ধনাঢ্য ভদ্রলোক ফাইনাল স্পিচ দিলেন, ‘এদেরকেই যখন আমি এক পয়সাও দিই না, তখন তোমরা আমার কাছে কী করে আশা করো?’