মানবতাবাদী দার্শনিক ও কবি লালন ফকির ফাল্গুনী পূর্ণিমা রাতে সাধুসঙ্গ করতেন। পূর্ণিমার আলো যেমন অন্ধকার দূরীভূত করে রাতকে আলোকিত করে, সাধুসঙ্গ তেমনি মনের অজ্ঞতার অন্ধকারকে দূরীভূত করে মানুষকে আলোকিত করে। মানুষকে জ্ঞানালোকিত করতে সাঁইজি ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে সাধুসঙ্গ করতেন বিধায় আমরা এই পূর্ণিমাকে লালন পূর্ণিমা হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। লালন ভক্তগণ প্রতিবছর এই দিনে সাধুসঙ্গে মেতে ওঠেন। এই দিনটিকে লালনোত্সব বললেও অত্যুক্তি হয় না। গৌতম বুদ্ধের নামে বুদ্ধপূর্ণিমা আছে, রাধা-কৃষ্ণের দোললীলার জন্য আছে দোলপূর্ণিমা। আছে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নামে গৌরপূর্ণিমা। সুতরাং আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর মানবাত্মার বিজ্ঞানী লালন ফকিরের নামে লালন পূর্ণিমা হতে পারে।
জ্ঞান-গরিমা ও দর্শনে বাঙালি যাদের নিয়ে গর্ব করতে পারে, তাদের অন্যতম হচ্ছেন লালন ফকির ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি হিসেবে দুই জন বাঙালির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। তাদের একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্যজন লালন ফকির। ২০০৫ সালের ২৭ নভেস্বর জাতিসংঘের ইউনেসকো বাংলার বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যায়িত করে একে বিশ্ব মানবতার ঐতিহ্যের ধারক বলে ঘোষণা দেয়। বাউল গানের সম্রাট হিসেবে লালন ফকিরই এ সম্মানের অধিকারী এবং বিশ্বমানবতার ধারক।
তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী ও পুরুষের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে এমন এক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, যে সমাজের মানুষ নিজেকে পরিচয় দেবে মানুষ হিসেবে, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-ইহুদি-শিখ হিসেবে নয়। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ বা জাতীয়তাবাদের মধ্যে নিহিত থাকে সংকীর্ণতা, উদারতা নয়। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে তার বেশির ভাগ হয়েছে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের জন্য। তাই লালন সাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবাদমুক্ত মানবিক সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। লালন বলেন,
‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।’
লালন কার্ল মার্কসের আগেই ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান লাঘব করে সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। যেমন তিনি বলেন,
‘আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই সবার পাওনা পাবে সবাই
আশরাফ বলিয়া রেহাই ভবে কেহ নাহি পাবে।।
শোনায়ে লোভের বুলি কেউ নেবে না কাঁধে ঝুলি
ইতর আশরাফ বলি দূরে ঠেলে নাহি দেবে।।’
কবি শেকসিপয়র তার ‘Hamlet’ নাটকে বলেছেন, ‘There is nothing either good or bad, but thinking makes it so.’ এমন কথা লালনও বলেছেন,
‘পাপ পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই
এক দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে পুণ্য তাই।’
ফরাসি দার্শনিক ও বিজ্ঞানী রিনি দেকার্তে বলেন, ‘Cogito, ergo sum’ (I think, therefore I am)।
লালনের গানেও আমরা এর সমান্তরাল কথা পাই। যেমন—
‘আমি সত্য না হলে গুরু সত্য হয় কোন কালে
আমি যেরূপ দেখ না সেরূপ দীন দয়াময়।।
অথবা, মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে
সে কি অন্য তত্ত্ব মানে।।’
ইংরেজ কবি, দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ Samuel Taylor Coleridge (১৭৭২-১৮৩৪) বলেন, ‘He prayth best who loveth best.’ লালন বলেন,
‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) তার প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘Song of Myself’-এ বলেন,
I celebrate myself, and I sing myself
And what I assume, you shall assume
তদ্রুপ লালনও বলেছেন,
‘আপনার আপনি হলে ফানা দেখা দিবেন সাঁই রাব্বানা
সিরাজ সাঁই কয় লালন কানা স্বরূপে রূপ দেখ সংক্ষেপে।।’
কবি শেকসিপয়ার (১৫৬৪-১৬১৬)) তার ‘Hamlet’ নাটকে বলেছেন, ‘There is nothing either good or bad, but thinking makes it so.’ তদ্রুপ লালনের গানেও রয়েছে—
‘পাপ পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই
এক দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে পুণ্য তাই।’
সনাতন (হিন্দু) ধর্ম পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। এ জনমে যে যেরকম কাজ করবে পরজনমে সে সেরূপ কর্মফল পাবে। ভালো কর্ম করলে এ জগতের চণ্ডাল পরজগতে হবে ব্রাহ্মণ। আর ব্রাহ্মণ কুকর্ম করলে পরজগতে হবে চণ্ডাল। কেউ যদি এ জগতে শিয়াল, কুকুর, বিড়ালের মতো কাজ করে পরজগতে শিয়াল, কুকুর, বিড়াল হয়ে জন্ম নেবে। বৌদ্ধ ধর্ম জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। লালনও পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। তবে সেটা সনাতন বা বৌদ্ধধর্মের মতো পুনর্জন্ম নয়। সেটা বিজ্ঞানভিত্তিক পুনর্জন্ম। জিন থিওরি অনুযায়ী সন্তান তার পূর্বপুরুষের জিন ধারণ করে দুনিয়াতে আসে। সন্তানের মাধ্যমেই মাতাপিতার পুনর্জন্ম। সন্তানই মাতাপিতার জিন ও অস্তিত্ব বহন করে। তাইতো সাঁইজি লালন বলেন,
‘পিতার বীজে পুত্রের সৃজন
তাইতে পিতার পুনর্জনম
পঞ্চভূতে দেহের গঠন
আলকরূপে ফেরে সাঁই ।।’
লালন ছিলেন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মরমি কবি, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, মুক্তচিন্তার অধিকারী ও দার্শনিক। তিনি তার গানে ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও গোত্রের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, লেখক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনকে একজন উঁচুমাপের কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি লালনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাকে উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘The village poet evidently agrees with our sage of Upaneshad who says that our mind comes back baffled in its attempt to reach the unknown being; and yet this poet like the ancient sage does not give up adventure of the infinite thus implying that there is a way to its realisation।’ লালন দর্শনে বিমোহিত হয়ে কবিগুরু বলেন, ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’ সক্রেটিস, ফ্রাঙ্কলিন, শেকসিপয়ার বা দেকার্তের নাম লালন শুনেছেন কি না জানি না। তবে তাদের দর্শন ও চিন্তার সঙ্গে লালনের দর্শন ও চিন্তার অনেক মিল রয়েছে। সক্রেটিস নিজে কিছু লিখে যাননি। তার শিষ্য প্লেটো তার সম্পর্কে লিখে তাকে কালজয়ী করে রেখেছেন। প্লেটোর ন্যায় কেউ যদি লালনকে নিয়ে লিখতেন, তাহলে লালন হতেন আরও খ্যাতিমান, বিশ্বজোড়া কালজয়ী দার্শনিক।