ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন-সার্বভৌম ইউক্রেনের মাটিতে বোমা ফেলে যে সংঘাতের শুরু করেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তা ভয়াবহ-ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। প্রথম দিকে বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন, সংঘাত বেশি দূর গড়াবে না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিশ্লেষকদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে—ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল সামনের দিকেই গড়াচ্ছে! ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর ভয়াবহ আগ্রাসনের এক বছর পর এটা এখন স্পষ্ট যে, কোনো পক্ষই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার মতো অবস্থায় নেই। আবার শান্তির রাস্তায় হাঁটার মতো মানসিকতাও নেই কোনো পক্ষের। এ অবস্থার মধ্যে দুই পক্ষের সেনাবহরে নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত হওয়ায় যুদ্ধ আরও লম্বা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এসব বিষয়কে সামনে রেখে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখেছেন জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনারের (ইউএন হাইকমিশনার অন রিফিউজি) সাবেক পরিচালক আলেকজান্ডার ক্যাসেলা।
উল্লেখ্য, আলেকজান্ডার ক্যাসেলা লা মঁদে, দ্য টাইমস, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ডের সাইট, দ্য গার্ডিয়ান, সুইস রেডিও ও টিভিতে সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। লেখালেখি করেছেন চীন এবং ভিয়েতনামের ওপর। ১৯৭৩ সালে ইউএনএইচসিআর-এ যোগদান করে পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান এবং এশিয়া ও ওশেনিয়ার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর জেনেভায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন নীতি উন্নয়ন কেন্দ্রের (ইন্টান্যাশনাল সেন্টার ফর মাইগ্রেশন পলিসি সেন্টার ডেভেলপমেন্ট) প্রতিনিধি হিসেবে ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উদ্দেশে লেখা আলেকজান্ডার ক্যাসেলার খোলা চিঠি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো—
আন্তোনিও গুতেরেস স্যার,
১৭ বছর হয়েছে, আপনি জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। প্রথমে শরণার্থীদের জন্য হাইকমিশনার হিসেবে ও ২০১৭ সাল থেকে সংস্থাটির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এই সুদীর্ঘ ১৭ বছর আপনি ১ নম্বর অলিখিত নিয়মটি কঠোরভাবে মেনে চলেছেন, যা পৃথিবীব্যাপী সব আন্তর্জাতিক বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য বয়ে এনেছে ‘পরম স্বস্তি’। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মজীবনকে আলোকিত করার পাশাপাশি নিজেকে আলোকিত করতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে আপনাকে বলতে শুনেছি—‘অন্যায্যভাবে কারো পায়ে পাড়া দিয়ে বিবাদ বাড়াবেন না।’
এ কথা চরম সত্য, কর্মজীবনে আপনি অগণিত ভালো কাজ করেছেন, যা নিয়ে প্রশংসা করতেই হয়। বছরের পর বছর ধরে আফ্রিকান দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঋণের অন্যায্য উচ্চ সুদের হারের নিন্দা করে আসছেন। সবাইকে বার বার সতর্ক করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের উসকানির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে। দরিদ্র দেশগুলোতে শিশুমৃত্যুর হার কমানোর বিষয়ে বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, করেছেন প্রতিবাদ। বিশ্বব্যাপী মহিলাদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। বিভিন্ন পক্ষের রেষারেষির খেসারত হিসেবে সারা বিশ্বে যে হারে শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, অব্যাহত রেখেছেন তীব্র প্রতিবাদ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তুলে ধরে বিশ্বের প্রতি আপনি বরাবরই আকূল আবেদন জানিয়ে আসছেন। মোটকথা, আপনার কথা বিশ্ব নেতৃত্বের কান পর্যন্ত পৌঁছাক বা না পৌঁছাক, আপনি আপনার কাজ করে চলেছেন। এসব বিষয়ে আপনি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য—এতে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না।
তবে, কিছু কথা আপনার উদ্দেশে স্পষ্ট করে বলা দরকার। আপনি বর্তমানে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে আপনার দ্বিতীয় ও শেষ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। সহজ ভাষায় বললে এর অর্থ, আপনি যেহেতু ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে গেছেন, তাই কর্মজীবনে ‘উজ্জ্বল সম্ভাবনা’র দিকে আপনার না তাকালেও চলে। কারণ, ক্যারিয়ারের প্রশ্নে আপনার হারানোর কিছু নেই। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, ‘স্যার, হয়তো সময় এসেছে, শুধু মুখে নয়, কিছু কাজ বাস্তবে করে দেখানোর!’
ইউক্রেনে ভয়ংকর যুদ্ধ চলছে। এক বছর অতিবাহিত হলেও এ সংঘাতকে থামনো যাচ্ছে না। এ যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনেই মানবিক সংকট সৃষ্টি করেনি, এর প্রভাবে কাঁপছে পুরো পৃথিবী! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংঘাতের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। এ যুদ্ধ যে বাঁচা-মরা, তথা জীবনযুদ্ধ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
স্যার, শুধু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে যে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, তাতে আপনার সংস্থার কি কিছুই করার নেই? আপনার ‘রাজনৈতিক জাতিসংঘ’কে এ মানবিক সংকটে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? বিশ্বসভ্যতা-বিশ্বমানবতাকে বাঁচানোর প্রশ্নে আপনার প্রতিষ্ঠান অনুপস্থিত কেন? হ্যাঁ, আপনি বহু যুক্তি দাঁড় করাতে পারবেন। বহু চুক্তির প্রসঙ্গ টানতে পারবেন। শত শত কঠিন শর্তের হিসাবনিকাশ হাজির করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র হচ্ছে, যুদ্ধ চলছে। সংঘাত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। বৃহত্তর সংঘর্ষের পথে রয়েছে বিবদমান শক্তিগুলো। সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলোর মুখে যেন একটাই কথা—‘চূড়ান্ত জয়’ অর্জন করা ছাড়া তারা ঘরে ফিরবে না! এসব শুনেও আপনার প্রতিষ্ঠান চুপ কেন? সংঘাত বন্ধের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে আপনার সংস্থা আসলেই কি ভাবছে কিছু?
এ যুদ্ধে ‘বিজয়’ শব্দটি আদতে কী? এর প্রকৃত সংজ্ঞাটাই বা কী? দিনশেষে এটা যে একটা ‘ফাঁপা’ শব্দ, এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। চলমান সংঘাতে ‘জয়’ শব্দটি যে ক্রমাগতভাবে বিশ্বকে মহা সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, তা হয়তো জাতিসংঘ না বুঝলেও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না বিশ্ববাসীর। ইউক্রেন যুদ্ধ দিন দিন যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে করে ‘বিজয়’ শব্দটি নিয়ে চিন্তা বাদ দিয়ে সমঝোতার পথে না হাঁটলে পারমাণবিক সংকটের হাত ধরে বিশ্ব ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে সময় নেবে না।
সেক্রেটারি জেনারেল স্যার,
সময় এসেছে, আপনার উঠে দাঁড়ানোর। আপনার সংস্থার মাঠে নামার। যুদ্ধের ময়দানে তরবারির ঝনঝনানির ইতি টানতে প্রধান সেনাপতি হিসেবে আপনার কঠোর পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছে সারা বিশ্বের মানুষ। আপনার দরাজ কণ্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় আছি আমরা। বিবদমান পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসাতে আপনার পরিকল্পনা জানতে উদগ্রীব হয়ে আছি আমরা। আপনার হাতে যত যুক্তিই থাকুক না কেন, একটি বিষয়ে আপনি আমাদের সঙ্গে একমত না হয়ে পারবেন না। নিরাপত্তা পরিষদকে বাইপাস করে সরাসরি সাধারণ পরিষদে ‘সমঝোতা সংক্রান্ত আলোচনা’ ঠেলে দিচ্ছেন না কেন? বিবদমান পক্ষগুলোকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করার সুবিধার্থে সরাসরি সাধারণ পরিষদের নেতৃত্বকে সামনে আনছেন না কেন? যা অনিবার্যভাবে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে পারে পক্ষগুলোকে।
স্যার, আপনি যদি তেমনটি করতে চান, তবে সে আলোচনায় আপনার পরিকল্পনায় বিশেষভাবে নিম্নলিখিত মৌলিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি—
এক. অবিলম্বে সম্পূর্ণরূপে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।
দুই. ইউক্রেনের দনবাসকে আগামী ১০ বছরের জন্য জাতিসংঘের প্রশাসনের অধীনে রাখতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, ভারত, তুরস্ক, ইসরায়েলের কার্যকর ও আধুনিক সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি যেসব দেশের চৌকস সেনা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত আছেন, তাদের সহায়তায় এ প্রশাসনকে চালানো যেতে পারে।
তিন. উক্ত ১০ বছর সময়কালে বড় পরিসরে পুনর্গঠন প্রচেষ্টা হাতে নিতে হবে। এবং এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত বা সরে যাওয়া সব বাসিন্দাকে অবাধে ফিরে আসার ব্যবস্থা করতে হবে।
চার. ১০ বছরের এই সময়সীমার পর জনগণকে স্বাধীনভাবে এ বিষয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে যে, তারা কোন দেশের সঙ্গে থাকে চায়, ইউক্রেন নাকি রাশিয়া? প্রয়োজনে গণভোটের মাধ্যমে এর মীমাংসা করতে হবে।
পাঁচ. ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ হিসাবে বৈধতা দেওয়া উচিত। তবে তা ৯৯ বছরের জন্য রাশিয়ার কাছে লিজ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ছয়. পুরো প্রক্রিয়াটি এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে তা সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হয়।
জনাব সেক্রেটারি জেনারেল, আপনার খুব ভালোমতোই জানা যে, প্রতিটি যুদ্ধই সাধারণত কোনো একটি পক্ষের পরাজয়ের মাধ্যমে কিংবা কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধের সব পক্ষ যেন একটি ‘ধুন্ধুমার’ অবস্থার মধ্যে আছে! এর কারণ, আলোচনার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তা যেন বন্ধ, নেই কোনো উদ্যোগ! ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে আপনার কঠোর হস্তক্ষেপ অতি জরুরি। যাহোক, আপনি যদি তা করতে না চান বা অপারগ বোধ করেন, তবে আপনার এই যুক্তিতে সরে যাওয়ার কথা বিবেচনা করা উচিত যে, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এমন একজন নতুন মহাসচিব বেছে নিক, যিনি ইউএন চার্টারে লিপিবদ্ধ নীতিগুলোর বাস্তবায়নে কর্তব্যবোধের জায়গা থেকে কাজ করবে। আশা করি, ইউএন চার্টারে মানুষের পক্ষে, মানবিকতার পক্ষে কাজ করে যাওয়ার বিষয়েই কথা বলা আছে!
এশিয়া টাইমস থেকে অনুবাদ: সুমৃৎ খান সুজন