গত ১১ ফেব্রুয়ারি চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে অন্যরকম একজন শেখ হাসিনাকে দেখল বাংলাদেশ। দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী, প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতা কিংবা নেতাকর্মীদের প্রিয় আপা হিসেবে নয়, গ্রাম বাংলার একজন আদর্শ কৃষক হিসেবে তিনি টিভি পর্দায় হাজির হয়েছেন। বিষয়টি চমকপ্রদ, কিছুটা বিস্ময়েরও। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের উপস্থাপনায় ‘শেখ হাসিনার ফসলি উঠোন, গণভবনে বাংলার মুখ’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচারের আগপর্যন্ত সাধারণ মানুষ কৃষক শেখ হাসিনাকে এতটা জানতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় ও দলীয় বহুবিধ কাজের ফাঁকে আবার নিজ সরকারি বাসভবনে নিজের মতো করে চাষাবাদও করছেন। একজন মানুষ কত কিছু করতে পারেন, তা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে না দেখলে বোঝা যাবে না।
তিনি সরকারি-বেসরকারি প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে জনগণকে আহ্বান জানিয়ে বারংবার একটি কথা বলছেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে, আমদানি চাপ কমাতে পতিত প্রতিটি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনতে হবে। যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, জমি আছে, সবাই সেখানে কিছু না কিছু উৎপাদন করেন। যে-যেভাবে পারেন নিজেদের খাদ্যোত্পাদনে সবাই একটু মনোযোগী হন, সাশ্রয়ী হন। পতিত জমি কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ আসবে না, বরং বিশ্ব খাদ্যসংকটে বাংলাদেশ অন্য দেশকে সহযোগিতা করতে পারবে।’ প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জনগণকে আহ্বান জানিয়ে বসে থাকেননি, তিনি নিজেও চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, সরকারি বাসভবনের প্রতি ইঞ্চি জমিকে তিনি চাষের আওতায় এনেছেন।
কী নেই সেখানে? গণভবনের আঙিনায় হাঁস, মুরগি, কবুতর, গরু, ছাগল পালনের পাশাপাশি ধান, গম, ফুল, ফল, সবজি, মাছ চাষাবাদ করছেন। তিল, সরিষা থেকে তেল ও মধু উৎপাদন হচ্ছে। এসব ফসল চাষাবাদে গণভবনের গরুর খামারের উৎপাদিত জৈব সার ব্যবহার করা হচ্ছে। পুরো গণভবনকে তিনি একটি কৃষিখামারে পরিণত করেছেন। শাইখ সিরাজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ছোটবেলা বাবার কাছেই কৃষির হাতেখড়ি। তিনিই আমাদের ভাইবোন বিশেষ করে কামাল ও আমাকে কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করতেন।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। এজন্যই তিনি কৃষির ওপর খুব গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের প্রথম চাহিদা খাদ্য, আর খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষক ও কৃষি উন্নয়নের বিকল্প নেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে কৃষি-অর্থনীতিতে স্বনির্ভর করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২২ লাখ কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ, সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা, বাজেটে ভর্তুকি দিয়ে বিনা মূল্যে সার ও কীটনাশক বিতরণ, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কৃষিকর্মী নিয়োগ, গরিব কৃষকের জন্য রেশনের ব্যবস্থা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। যার ফলে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কৃষি ফসল উৎপাদিত হয়েছে।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। তখন দেশে ২৬ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। সারে ভর্তুকি, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, উন্নত বীজ সরবরাহ ও কৃষিপণ্যের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থার কারণে মাত্র পাঁচ বছরে বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতি কাটিয়ে ওঠে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময়ে দেশে ৪০ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিল। খাদ্যনিরাপত্তার কারণে ২০০১ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘সেরেস পদকে’ ভূষিত করে। ২০০১-২০০৮ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আবার কৃষি খাতের উন্নয়ন থমকে গিয়েছিল।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চাষের জমি কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ, কিন্তু ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ। এক সময়ের বিদেশি ফল হিসেবে খ্যাত এস্ট্রোবেরি, কমলা, মাল্টা, ড্রাগন, কাজু বাদামসহ বিভিন্ন ফল বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে দেশের মানুষ সহজেই এই সুস্বাদু ফলগুলো খেতে পারছে।
কৃষিই বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। এজন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যুগোপযোগী কৃষিনীতি প্রণয়ন করেছে। জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উন্নত কৃষি ব্যবস্থার বিকল্প নেই। স্বাধীনতার পর দেশে জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। প্রতিনিয়তই আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে।
কিন্তু খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এখনো অনেক শিক্ষিত লোকেরা মনে করে কৃষিকাজ তাদের নয়, এটা গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত লোকের কাজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে, যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্ট পরা-কাপড় পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই জমিতে যেতে হবে। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ঐ শহিদদের কথা চিন্তা করে ডবল ফসল করতে হবে। যদি ডবল ফসল করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাল্লাহ হবে না।’ জাতির পিতার স্বপ্নপূরণ হয়েছে, এখন দেশের অধিকাংশ জমিতেই ডবল ফসলের চাষাবাদ চলছে, বাংলাদেশ থেকে খাদ্যাভাব একপ্রকার দূর হয়েছে। ভবিষ্যতের সংকট দূরীকরণে দেশরত্ন শেখ হাসিনার দেখানো পথে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের প্রতিটি ইঞ্চি জমিকে আবাদের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই ভিশন-৪১ উন্নত-সমৃদ্ধ-স্বনির্ভর সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে।