কয়েক দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকার রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রপ্তানি বহুমুখীকরণের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে অন্তত ছয়টি খাত রপ্তানি আয়ের অর্ধ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত এক দশকে আরও চারটি খাত বিলিয়ন ডলারে স্পর্শ করেছে। ছয়টি খাতের মধ্যে কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং হোম টেক্সটাইল ইতিমধ্যেই বিলিয়ন ডলার আয়ের সীমা অতিক্রম করেছে।
অন্যদিকে, হালকা প্রকৌশল এবং পাদুকা পণ্য (চামড়া বাদে)ও অর্ধ বিলিয়ন ডলারের অঙ্ক ছুঁয়েছে। এছাড়াও, রাসায়নিক, রাবার, কার্পেট, আসবাবপত্র, বিশেষায়িত টেক্সটাইল, প্লাস্টিক পণ্য, কাচ এবং কাচের জিনিসপত্র আরও কিছু পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য এনেছে। সেসব পণ্যের রপ্তানি থেকে আয়ও বাড়ছে। রপ্তানি বৈচিত্র্য করতে কৃষি খাতেরও অবদান বাড়ছে। বিশেষ করে ভুট্টা, শাকসবজি, ফল এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারসহ কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে ভালো সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ১০ বছর আগে কৃষিপণ্য থেকে রপ্তানি আয় রেকর্ড করা হয়েছিল মাত্র ৪০২.৭০ মিলিয়ন ডলার। গত ২০২২ অর্থবছরে এ আয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
ইপিবি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ তেল বীজ, তৈলযুক্ত ফল, শস্য, বীজ এবং ঔষধিগাছ রপ্তানি করে ৫৫.২০ মিলিয়ন ডলার আয় করে। পশু বা উদ্ভিজ্জ চর্বি এবং প্রাণী বা উদ্ভিজ্জ মোম রপ্তানি করা হয়েছে ২৩০.০৯ মার্কিন ডলারে। এসব রপ্তানির অধিকাংশ গন্তব্য সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, মধ্যপ্রাচ্যে, যুক্তরাজ্য, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ।
এটা সত্য যে রপ্তানি ঝুড়িতে তৈরি পোশাকের অংশ সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৮২ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে এবং এ খাতে রপ্তানি বেড়েই চলেছে। আরও কিছু পণ্যের রপ্তানি বাড়লেও মোট রপ্তানিতে এগুলোর অংশ এখনো নগণ্যই বলা চলে।
একসময় রপ্তানি খাতের শীর্ষ অবস্থানে ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। এ অর্থকরী ফসল বিভিন্ন কারণে বাজার ধরে রাখতে পারল না। উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় চাষিদের মধ্যে পাট চাষের আগ্রহ হ্রাস পেতে থাকে। ধান, গম ও অন্যান্য খাদ্যপণ্য উৎপাদনের দিকে তারা ঝুঁকতে থাকেন। এতে উৎপাদন ও আয় উভয়ই বৃদ্ধি পায়। ১৯৮১-৯০-এর দশকে রপ্তানি ঝুড়ির আকার উল্লেখযোগ্য হারে প্রসারিত হয়। এ সময় আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প দ্রুত প্রসার লাভ করে। ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ সেক্টর স্থানীয় অদক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিকের ব্যাপক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে থাকে। তবে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য গুটি কয়েকটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল বিধায় ঝুঁকিপূর্ণ। রপ্তানি বাণিজ্যের এ প্রবণতা সামগ্রিক অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করছে। এটা অনুধাবনযোগ্য যে, বিশ্ব অর্থনীতি করোনা ভাইরাস হতে উদ্ভূত অতিমারি পরিস্থিতি হতে উত্তরণ না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এ বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটকে আরও প্রকট হতে প্রকটতর করে তুলেছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে পুরোপুরি বের হয়ে গেলে অন্যতম রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপের বাজারে বেশ কিছু বাণিজ্য সুবিধা হারাবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভর না করে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্য করার দিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি ইউরোপের বাইরে অন্যান্য অঞ্চলেও রপ্তানি বাজার বাড়াতে হবে। প্রসঙ্গত, এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে এ প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হবে। এর পর রপ্তানিতে এখনকার মতো শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। এলডিসি-বহির্ভূত অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যেও নিয়মিত শুল্ক আরোপিত হবে। এতে রপ্তানি আয় অন্তত ৮০০ কোটি ডলার পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও তিন বছর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বিদ্যমান অনেক সুবিধা হারানোর বিপরীতে কিছু সুবিধাও মিলবে। কিন্তু পরিবেশগত বিষয়সহ অনেক কঠিন শর্ত পূরণ করে তবেই সুবিধাগুলো অর্জন করতে হবে, যা অনেক চ্যালেঞ্জের।