শেষ হলো বাংলা একাডেমি আয়োজিত জাতির মননের বইমেলা যা শুরু হয়েছিল পহেলা ফেব্রুয়ারি এবং শেষ হয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষত বইপ্রেমী ও লেখক-প্রকাশকদের প্রাণের এই মেলার। কভিড-১৯ মহামারির কারণে গত দুই বছরের মন্দা কাটিয়ে অমর একুশে বইমেলা ২০২৩-এ বই বিক্রিতে রেকর্ড গড়ার প্রত্যাশা করেছিলেন প্রকাশক ও বিক্রেতারা। তবে আশানুরূপ না হলেও তারা অখুশি নন। এ বছরের বইমেলার প্রতিপাদ্য ছিল ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহিদের ত্যাগকে জাগরুক রাখতে এই মেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’। সে কারণে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ধরে চলে এর আয়োজন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জনপ্রিয় প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বটতলায় কলকাতা থেকে আনা কিছু বই নিয়ে মেলার সূচনা করেন। চিত্তরঞ্জন সাহার মুক্তধারা প্রকাশনী ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। তার দেখাদেখি অন্যরাও উত্সাহী হন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত স্বল্পপরিসরে মেলা চলতে থাকে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক বাংলা একাডেমিকে বইমেলার সঙ্গে সমন্বিত করেন। তারই উদ্যোগে ১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি বইমেলার ব্যবস্থাপনায় অংশীদার হয়ে ওঠে।
মেলার শেষবেলায় মেলাপ্রাঙ্গণে উপচেপড়া ভিড় দেখা গিয়েছিল, বিক্রয়কর্মীরা ব্যস্ত পাঠকদের চাহিদামাফিক বই সরবরাহে ব্যস্ত দেখা যায়। অনেক দর্শনার্থী বলেছেন, ‘দেখতে দেখতে মেলা শেষ হয়ে এলো, নানা ব্যস্ততায় এ বছর মেলায় বেশিদিন আসাই হয়নি, আবার এক বছর পর মেলা বসবে’। তবে মেলায় ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থী বেশি ছিল বলে জানিয়েছেন ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রেতা মোহাম্মদ মোস্তাকিম। তিনি বলেন, ‘আগামী এক বছরের জন্য মেলা শেষ হয়ে গেছে, অনেকে আসছিলেন শেষবারের মতো মেলা ঘুরে দেখতে’। এদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় না থাকায় ও সঠিক সময়ে মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবার বিক্রির পরিমাণ গত বছরগুলোর তুলনায় বেশি হবে বলে মনে করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা যা একশত কোটির কাছাকাছি হতে পারে। কারণ মহামারিতে ২০২১ ও ২০২২ সালের মেলা পূর্ণাঙ্গভাবে ও সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়নি যার ফলে লোকসান গুনতে হয়েছিল সকল বিক্রেতাকে। আবার ঝড়-বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলেও পড়েনি এবারের মেলা। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে মহামারির টালমাটাল অবস্থায় যথাক্রমে ৩ কোটি ১১ লাখ এবং ২০২২ সালে মহামারির প্রকোপ একটু কমে আসায় ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। তবে ২০২০ সালে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল বলে বাংলা একাডেমি জানিয়েছিল। সে হিসেবে টাকার অঙ্কে এ বছর বিক্রির পরিমাণ শত কোটি টাকা তো ছাড়াতে পারেনি, বরং ৪৭ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এবারে মেলার শেষ দিন বিকাল ৫টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিলেন ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৩’-এর সদস্য-সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে. এম. খালিদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানে ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২’, ‘কবি জসীমউদদীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩’ এবং অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২২ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩’ প্রদান করা হয় আগামী প্রকাশনীকে। এছাড়াও ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে আহমদ রফিক রচিত ‘বিচ্ছিন্ন ভাবনা’ প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস পাবলিকেশন্স, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ রচিত ‘বাংলা একাডেমি আমার বাংলা একাডেমি’ বইয়ের জন্য ঐতিহ্য প্রকাশন এবং হাবিবুর রহমান রচিত ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ প্রকাশের জন্য পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়। ২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খিকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩’ প্রদান করা হয়। ২০২৩ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুথিনিলয় (প্যাভিলিয়ন), নবান্ন প্রকাশনীকে (২-৪ ইউনিট) ও উড়কি (১ ইউনিট) ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩’ প্রদান করা হয়।
এই মেলায় শিল্প সংস্কৃতি চর্চার অন্তরালে একটি ব্যাবসায়িক দিকও ছিল। এবার বাংলা একাডেমি যে ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে ১০১টি ইউনিট বরাদ্দ দিয়েছে তা থেকে প্রাপ্তি কত, সে প্রশ্নটি আসাই প্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ এই প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব আয় কত হয়েছে তা জানা না গেলেও অঙ্কটি যে অর্ধকোটি কিংবা তার কাছাকাছি হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। রাজস্ব আয়ের খাতটি বাংলা একাডেমির মতো একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় সার্বিক দিকের উন্নয়নের বিবেচনায়। এ ছাড়া এই বাড়তি আয় সরকারের রাজস্ব আয়ের ভান্ডারে আরো একটি নতুন সংযোজন। আবার যারা স্টল বরাদ্দ নিয়ে তাদের বই প্রদর্শনের আয়োজন করে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে, যার মধ্যে রয়েছে পূর্বে আলোচিত প্রকাশক, লেখক, ব্যাবসায়ীদেরও দিন শেষে আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব রাখতে হয় এই মেলাকে ঘিরে। বইমেলা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে যার সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা জড়িত, তথা বেকারত্বের অবসান ঘটায়। সেই হিসাবে একুশে বইমেলা বই বিক্রেতা, প্রকাশক, ছাপাখানা, বই বাইন্ডিং প্রভৃতি খাতের সঙ্গে জড়িতদেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করে। একটি বইকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে অনেক মানুষের অবদান থাকে। যেমন- প্রথমত, লেখক লেখেন, কম্পোজিটর হাতের লেখাকে কম্পিউটারে কম্পোজ করেন, প্রচ্ছদশিল্পী বইয়ের চরিত্র অনুযায়ী প্রচ্ছদ আঁকেন, প্রকাশক পাণ্ডুলিপি ভেদে নির্ধারিত মাপে কাঠামো দাঁড় করান। তারপর কাগজে প্রিন্ট করার পর পাণ্ডুলিপি যায় বানান সংশোধকের কাছে, সচরাচর তারা প্রতি ফর্মা ১০০ থেকে ৫০০ টাকায় দেখে থাকেন। অতঃপর লেখক-প্রকাশকের সম্মিলিত উদ্যোগে পাণ্ডুলিপি ফাইনাল করা হলে প্রেসে যায়।
তবে আয়োজক সংস্থা বাংলা একাডেমি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও তাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই মেলার আয়োজন করতে হয়। বিশেষত দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয়। বইমেলার অর্থনীতি থেকে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি যেমন লাভবান হয়, তেমনি সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি হয়। একুশে বইমেলা চলার সময় একইসঙ্গে সারা দেশে জেলায় জেলায় এই বইমেলার আয়োজন করা যায় কিনা তা চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।