চোখের পলকে লাখ লাখ তাজা প্রাণ কেড়ে নিতে পারে একটিমাত্র পারমাণবিক অস্ত্র। কোনো এলাকায় পারমাণবিক হামলা চালালে সেই অঞ্চল তো বটেই, তার চারপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে ধ্বংসযজ্ঞ! পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ফলে পরমাণুযুদ্ধের অবতারণার মধ্য দিয়ে ধ্বংসলীলা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। পারমাণবিক বোমার আঘাতে বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয় কণা ধুলোর সঙ্গে মিশে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে। বিশাল অঞ্চল জুড়ে মারাত্মক বিকিরণ ঘটবে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব হিসেবে বিশ্বব্যাপী শুরু হবে দুর্ভিক্ষ। লাখে লাখে ঝরবে মানুষ, পশুপাখির প্রাণ। ভাবা যায় এ দৃশ্য!
পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় আক্রান্ত অঞ্চল এতটাই বীভৎসভাবে পুড়ে যাবে যে, প্রাণ বাঁচাতে নিজস্ব বায়ুব্যবস্থা তৈরি করার দরকার পড়বে। কোনো শহরের ওপর যদি পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়, তবে সেখানে যে অগ্নিঝড় বয়ে যাবে, তাতে ঐ শহরের বাতাস হয়ে উঠবে প্রচণ্ড উত্তপ্ত। প্রচুর তাপের সৃষ্টি হবে। অগ্নিঝড় থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া ও তাপের কারণে কবলিত এলাকায় সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারবে না। বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যাবে। আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। এ ধরনের অবস্থা চলবে বছরের পর বছর। কী বিভত্স!
উল্লেখ করা জরুরি, কোনোভাবে যদি বিশ্বে পারমাণবিক সংঘাত শুরু হয়, তবে তা ডেকে আনবে বৃহত্তর পারমাণবিক যুদ্ধ। এর ফলে প্রথম দিকে আগুনের তাপে পুড়ে ছাই হবে জানমাল। এরপর শুরু হবে ‘পারমাণবিক শীতলতার দাপট’। এর কারণ, আগেই বলা হয়েছে—বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যাবে, চারপাশ অন্ধাকারে ঢেকে যাবে। ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি তো হবেই, তাছাড়া বিশেষ করে ইউরেশিয়া ও উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক কৃষি অঞ্চলে তাপমাত্রা ব্যাপক হারে কমে গিয়ে কৃষিকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। বিশ্বব্যাপী দেখা দেবে ‘দুর্ভিক্ষ’। এই ‘পারমাণবিক দুর্ভিক্ষ’ পৃথিবীর জন্য যে কী মাত্রায় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে, তা বুঝতে কারো বাকি থাকার কথা নয়। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মরবে কেবল না খেতে পেয়ে!
অর্থাৎ, এটা অত্যন্ত সহজ হিসাব—পারমাণবিক সংঘাতের ক্ষয়ক্ষতি কেবল তাৎক্ষনিক নয়, বরং এর প্রভাব রয়ে যায় দীর্ঘ মেয়াদে। পারমাণবিক অস্ত্রের হামলার প্রভাব শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। শুধু আক্রান্ত অঞ্চল বা দেশ নয়, পারমাণবিক যুদ্ধের ফলে আক্রমণকারী দেশসহ সারা বিশ্বে বয়ে যাবে ধ্বংসলীলা।
মূলত, বৈশ্বিক ধ্বংসযজ্ঞের অনিবার্য পরিণতিই পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনাকে অতিমাত্রায় ভয়ংকর করে তোলে। আর এ কারণেই যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা দেখা দিলে তা সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার আমাদের যে কী মাত্রায় আত্মধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে, তা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়!
স্নায়ুযুদ্ধের যুগে অবস্থা যখন দিনে দিনে খারাপ হচ্ছিল, সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান একটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন, ‘পারমাণবিক যুদ্ধে আসলে কোনো পক্ষই জয়ী হতে পারবে না। তাই কখনোই আমাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পথে হাঁটা উচিত নয়। যেসব রাষ্ট্রের পারমাণবিক ভান্ডারে এই মারণাস্ত্র মজুত আছে, তাদের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে, এগুলো কখনোই ব্যবহার করা হবে না। তারপর ধীরে ধীরে এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারাটাই হবে আসল কাজ।’
আজকের যুগে আমরা দেখছি, পারমাণবিক মজুত হ্রাস পেয়েছে বটে, তবে একই সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে উচ্চ ঝুঁকি। প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের আহ্বানের পর ৪০ বছর পার হয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু পারমাণবিক মজুত যথেষ্ট পরিমাণে কমলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঝুঁকি হ্রাস করতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ব। বিশ্ব আজ বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে, পারমাণবিক অস্ত্র ‘নিরস্ত্রীকরণ’ কতটা কঠিন কাজ!
আমাদের গ্রহের বিভিন্ন দেশের হাতে এখনো প্রায় ১০ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র সংরক্ষিত আছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, কোনো কোনো অস্ত্র এতটাই বৃহৎ আকারের যে, তা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করা অস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর! একটি-দুটি অস্ত্রই বিশ্বের জন্য ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ মাত্রার বিপর্যয়।
সত্যি বলতে, পারমাণবিক যুদ্ধের পরিণাম কী হতে পারে, তা বেশ ভালোমতোই জানে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো। এর পরও যদি কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, তা হবে বিশ্বমানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধ বিশ্বের জন্য যে ভয়াবহ ধ্বংস-বিপর্যয় ডেকে আনবে, তা হবে মানবতার বিরুদ্ধে হানাহানি-সংঘাতের চূড়ান্ত রূপ।
এখন প্রশ্ন হলো, পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি কীভাবে এড়ানো যায়—এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, ঝুঁকি তখনই শূন্যের কোঠায় নামবে, যখন পৃথিবী থেকে সব পারমাণবিক অস্ত্র সরিয়ে ফেলা হবে। আমি মনে করি, মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রশ্নে আমাদের এই কাজই করা উচিত। যদিও এটা রাতারাতি ঘটবে না, তবে যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে। এর জন্য দরকার বিশ্বকে ‘শান্তিপূর্ণ ভূমি’ হিসেবে গড়ে তোলা। এতে করে নিশ্চিতভাবে পারমাণবিক সংঘর্ষের ঝুঁকি কমবে। সর্বোপরি, আমাদের এমন সব প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যাতে যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। বাস্তবিক অর্থে যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস পেলে তা পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনাকেও কমিয়ে দেবে। পারমাণবিক সংঘর্ষের ঝুঁকি কমানোর আরেকটি বড় উপায় হতে পারে ‘পারমাণবিক চুক্তি’। পারমাণবিক মজুত কমানোর বিষয়ে পুরোনো চুক্তি নবায়নের পাশাপাশি নতুন চুক্তির বিষয়ে ভাবতে হবে। যদিও এই পথে হাঁটছে না বিশ্ব। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অস্ত্র চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ থেকে বের হয়ে যাওয়ার মনোভাব পোষণ করেছেন, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর ফলে পারমাণবিক ঝুঁকি কমার পরিবর্তে বেড়ে গেছে অনেকখানি।
আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে বোঝাপাড়ার পরিবেশ তৈরি হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। সবার মধ্যে এই বোধ তৈরি করাটা অতি জরুরি যে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের একটাই লক্ষ্য—পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি রোধ করা। আমরা কেউই পারমাণবিক ঝুঁকিময় বিশ্বে বাস করতে চাই না—এ মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা কেউই মরতে চাই না—এই সংকল্পে পৌঁছাতে হবে সবাইকে। বিশ্ববাসীকে সর্বদা মনে রাখতে হবে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের কথা—‘পারমাণবিক যুদ্ধে আদতে জয়ী হওয়া যায় না। তাই পারমাণবিক অস্ত্রগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করাই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত।’
একটা সময় পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলন সফলও হয় অনেকাংশে। কিন্তু তারপর দুর্ভাগ্যবশত লক্ষ্য থেকে সরে এসেছি আমরা। এর ফলে আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। আজকের বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো এমন সব অস্ত্র হাতে নিয়ে বসে আছে যে, কোটি কোটি মানুষ মারা পড়বে পারমাণবিক বোতামে আঙুলের এক চাপেই! এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বিশ্ব প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের রাস্তা থেকে পক্ষগুলোকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর এর দায়িত্ব নিতে হবে বিশ্বনেতৃত্বকেই। অনেকেই আছেন, যারা পারমাণবিক সংঘাতকে খুব বড় করে দেখতে চান না। এটা একটা মারাত্মক ভুল চিন্তা।
আট দশক ধরে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে আসছে বিশ্ব। বেশ কয়েকটি দেশ এ কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও স্নায়ুযুদ্ধ না হলে বিশ্ব হয়তো কখনোই এসব অস্ত্র তৈরি করার কথা চিন্তা করত না। তবে আমি আশা করি, বিশ্বে আজ এমন অনেকেই আছেন, যারা বিশ্বশান্তির স্বার্থে পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি কমানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত সত্যিই যদি পারমাণবিক অস্ত্রের রাস্তা থেকে আমরা সরে আসতে পারি, তবে তা হবে ধ্বংসের বিরুদ্ধে মানবতার বিজয়।