প্রেরণা শব্দটি ব্যাখ্যা করলে নানাভাবে উপস্থাপন করা যায়। তবে এক্ষেত্রে সামাজিক ও মানসিক প্রেরণাকে প্রাধান্য দিয়ে আলোচ্য বিষয়টি উপস্থাপন করার প্রয়াস নেওয়া যায়। সেই সঙ্গে ইতিহাস উপজীব্য করে সামগ্রিক আলোচনাটিকে কাঠামোবদ্ধ করা গুরুত্ববহ। কেননা, এখানে তিনটি প্রজন্মকে সংযুক্ত করে যেমন:বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, তরুণ প্রজন্ম আর প্রেরণাকে উল্লেখ করা হয়েছে। যথাযথ ইতিহাস, সামাজিক, মানসিক বিষয়টি সংযুক্ত হয়েছে।
এই সংযুক্ততা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেন, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সমাজের সক্রিয় ভূমিকায় তরুণ প্রজন্ম, আর এই তরুণ প্রজন্মের মানসিক প্রেক্ষিত তাদের মন ও মননে উদ্বুদ্ধকরণের চেতনা সমন্বিত প্রেরণা। উল্লিখিত এই তিনের সমন্বিত উপস্থাপন বর্তমান বাংলাদেশে অতীব প্রয়োজন। তার মধ্যে রয়েছে ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল, ১৯৭১-এর ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে উল্লিখিত প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে অসাধারণ প্রেরণা জোগাবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ব্রেনচাইল্ড’ ঐতিহাসিক ৬ দফা দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বাধীকার থেকে আত্মমর্যাদাশীল সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে সমগ্র বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ গণ-অভ্যুত্থান দেশপ্রেমের চেতনার শাণিত ফসল। এই জাগ্রত চেতনা ও প্রেরণার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফলে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ফলাফলের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিষ্ঠিত হন অবিসংবাদিত এক নেতৃত্বে। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার আপামর জনগণই তাদের মন-মননে বঙ্গবন্ধুকে একক নেতৃত্ব ও দেশপ্রেমের প্রেরণার উৎস হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন। ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশনা হয়ে ওঠে অত্যন্ত তাত্পর্যবহ। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা অপরিহার্য। কেননা, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্বাপর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তৎকালীন আপামর বাঙালির আত্মত্যাগ তথা নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমের চেতনা, যা অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির যে আত্মত্যাগ, শোষণ, নির্যাতন, জেল-জুলম হুলিয়ায় আবর্তিত, তার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন। প্রায় ১৩ বছরের অধিককাল জেলে বন্দি বঙ্গবন্ধু সব নির্যাতন সহ্য করেছেন বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায়। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে লাখ লাখ নেতাকর্মী নির্যাতন, জুলুম সহ্য করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের নেতারা। তাদের ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে দেশপ্রেমের এই চেতনা। এই চেতনাকে ভিত্তি করে দলমত-নির্বিশেষে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল জনগণ। ব্যতিক্রম ছিল শুধু স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থি কতিপয় রাজনৈতিক দল ও কিছু মানুষ, যারা আলবদর, রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষাণটি ছিল মূলত স্বাধীনতা ঘোষণার ভাষণ, যেটাকে আমার বিশ্লেষণে ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঘোষণা’ আর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা হলো ‘প্রসাশনিক স্বাধীনতা ঘোষণা’। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রতিটি বাক্যে আপামর বাঙালিকে উদ্বুদ্ধকরণ, চেতনা জাগ্রতকরণ, প্রেরণাদান, সর্বোপরি নির্দেশনা দান করেন। বঙ্গবন্ধু তার ঐ ভাষণে জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রস্তুতির নির্দেশনা দেন। সর্বোপরি তার ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে মূলত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তথা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার আপামর মানুষ অধীর আগ্রহে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিলেন। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে আপামর বাঙালির অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। শুরু হয় দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে, যার নাম বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির যে শক্তি, তা হলো আপামর বাঙালির দেশপ্রেমের শক্তি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে প্রেরণা, তা হলো দেশপ্রেমের প্রেরণা; বাংলাদেশ পাওয়ার যে সংগ্রাম, তা হলো আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়ার চেতনা; সর্বোপরি সঠিক সময়ে যথাযথ নির্দেশনায় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা।