বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশকে ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। নদীগুলো আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে এবং আজও অবদানের ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে। একসময় এই নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল দেশের অর্থনীতি। নদ-নদীই ছিল জীবন ও জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। তাই বাংলার সাহিত্য-কবিতায় নদ-নদীর রয়েছে মহিমান্বিত স্থান। এর মধ্যে তেমনি একটি নদী বুড়িগঙ্গা। কিন্তু যন্ত্রচালিত শিল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরাই তিলে তিলে ধ্বংস করে দিয়েছি নদীগুলো। তেমনি মানুষের নির্মমতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা নদী বাংলাদেশের উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৯ কিলোমিটার, প্রস্থ ৩০২ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা ‘পাউবো’ কর্তৃক বুড়িগঙ্গা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নম্বর ৪৭। ৪০০ বছর আগে এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল ঢাকা শহর। ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে বুড়িগঙ্গা নদীর সৃষ্টি হয়েছিল। তবে বর্তমানে এটা ধলেশ্বরীর শাখাবিশেষ। কথিত আছে, গঙ্গা নদীর একটি ধারা প্রাচীনকালে ধলেশ্বরী হয়ে সোজা দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশেছিল। পরে গঙ্গার সেই ধারার গতিপথ পরিবর্তন হলে গঙ্গার সঙ্গে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে প্রাচীন গঙ্গা এই পথে প্রবাহিত হতো বলেই এমন নামকরণ। মূলত ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। কলাতিয়া এর উৎপত্তিস্থল। আমার বুকে লিখে রেখেছ—নদী বাঁচলে, বাঁচবে দেশ। কিন্তু সেই নদী বুড়িগঙ্গা আজ মারাত্মকভাবে দূষণের স্বীকার, দখলের স্বীকার। লাইফ সাপোর্টে। বর্তমানে উৎসমুখটি ভরাট হওয়ায় পুরোনো কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বুড়িগঙ্গা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
সাভার থানার ৬.৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ফুলবাড়িয়ার কাছে ধলেশ্বরী থেকে বের হয়ে ঢাকা শহরের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নারায়ণগঞ্জের চার কিলোমিটার পশ্চিমে ভূইরা নামক স্থানে ধলেশ্বরীতে পড়েছে জোয়ার-ভাটার নদী বুড়িগঙ্গা। ঢাকা শহরের কামরাঙ্গীচরের কাছে তুরাগ নদ বুড়িগঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়। মূলত বুড়িগঙ্গার জলপ্রবারেহ প্রধান অংশটাই আসে তুরাগ থেকে। প্রথমত এই নদী কিঞ্চিত দক্ষিণ-পূর্বমুখী হয়ে কিছু দূর অগ্রসর হয়েছে। তারপর বনগ্রাম-মান্দাইল স্থানদ্বয় থেকে সোজা পূর্বদিকে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। অতঃপর বুড়িগঙ্গা সেতু পেরিয়ে আবার দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ভবানীগঞ্জ হয়ে মুন্সীগঞ্জের ভুইরা নামক স্থানে আবার ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ছাগলকান্দির কাছে বুড়িগঙ্গার উজান অঞ্চল পলি জমে ভরাট হয়ে পড়েছে। তবে ভাটি অঞ্চল সারা বছরই নাব্য থাকে। ১৯৮৪ সালে এর পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯০২ কিউসেক। বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পানি প্রবাহের পরিমাণ অর্ধেকেরও কম!
বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ করেছিলেন বাংলার সুবাদার মুকাররম খাঁ। তার শাসনামলে শহরের যেসব অংশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেখানে প্রতি রাতে আলোকসজ্জা করা হতো। এছাড়া নদীর বুকে অংসখ্য নৌকায় জ্বলত ফানুস বাতি। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হতো। ১৮০০ সালে টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে, তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।’
এই নদীর গড় গভীরতা ৭.৬ মিটার (২৫ ফুট) এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ১৮ মিটার (৫৮ ফুট)। বলা হয়ে থাকে, জোয়ারের সময় বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তাল ঢেউ মুঘলদের মুগ্ধ করেছিল। বিশ শতকে পলিথিন, কারখানার বর্জ্য এবং নদীর তীরে অবস্থিত ভবনগুলো ভেঙে ফেলায় এই নদী ব্যাপকভাবে দূষিত হয়। বর্তমানে বুড়িগঙ্গার প্রবাহ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। সুস্থভাবে বুড়িগঙ্গাকে অবলোকন করা এবং তার উপকার গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে কিছু হীন স্বার্থান্বেষী মুখোশধারী মানুষের নদী দখল ও দূষণমূলক কার্যক্রমের কারণে। যেই বুড়িগঙ্গা একসময় মানুষের মাছের চাহিদা পূরণ করতে, ব্যবহারযোগ্য জলের অভাব পূরণ করতে নিঃসংকোচ চিত্তে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে; সেই বুড়িগঙ্গা আজ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে!
বলা হতো, টেমসের তীরে যেমন লন্ডন, সেইনের তীরে প্যারিস, দানিয়ুবের তীরে বুদাপেস্ট, তেমনি বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা। ঢাকার দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। পদ্মা নদীর গতি পরিবর্তনের কারণে স্রোতধারা অনেক দক্ষিণে সরে গেলে পরিত্যক্ত ক্ষীণ ধারাটি বুড়িগঙ্গা নামে পরিচিতি পায়। অতীত ইতিহাস বলে, এটি ছিল জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত একটি নদী। এই নদীর জোয়ার-ভাটার রূপ দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েছিলেন মোগলরা। অনেকেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন বুড়িগঙ্গার। বুড়িগঙ্গার এই রূপ স্থায়ীভাবে উপভোগ করতে মোগলরা চলে আসেন ঢাকায়। ১৬১০ সালে বুড়িগঙ্গার তীরে স্থাপন করেন ঢাকা নগরী। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেও বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানি ঢাকার সেই আদি জনপদকে বিনা মূল্যেই ভেনিস দেখার ব্যবস্থা করে দিত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদীর অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে লিখেছেন কবিতা। বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন—সমালয় সন্নিহিত বুড়িগঙ্গা প্রবাহিত বন্দাঘাট শোভিত যাহাতে সেখানে বসিয়ে গিয়ে জুড়ায়া সন্তপ্ত হিয়া সলিল শিকারসিক্ত রাতে।
ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম—ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। তখন থেকে মনের ক্যানভাসে কেবলই বুড়িগঙ্গার ছবি ভেসে উঠত। না জানি বুড়িগঙ্গা দেখতে কত সুন্দর! বইয়ের পাতায় দেখা বুড়িগঙ্গা নদীর স্বচ্ছ জলে ছিল সারি সারি নৌকা। মাঝি গলা ছেড়ে গান গাইছে ‘মাঝি বাইয়া যাও রে’। কল্পনার সেই বুড়িগঙ্গার সঙ্গে বর্তমানের বুড়িগঙ্গাকে কোনোভাবেই মেলানো যায় না। যে আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে বুড়িগঙ্গার রূপ দর্শন করতে গেলাম; তার জীর্ণশীর্ণ, শ্রীহীন, দূষিত, দুর্গন্ধময় চেহারা দেখে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যথিত হলাম। কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে!
পৃথিবীর ইতিহাস বলে, সর্বত্রই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে নদীকূলকে কেন্দ্র করে। নদী মানুষকে সভ্য করে তুলতে সাহায্য করেছে। এসব নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল হাজারো জনপদ। তেমনি নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক নগরী ঢাকা। মোগল, ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ঢাকার বয়সও ছাড়িয়ে গেছে ৪০০ বছর। এই নদীকে কেন্দ্র করে ঢাকা হয়ে ওঠে অন্যতম বৃহত বাণিজ্যিক নগরী। পণ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে যাত্রী পরিবহন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবই বাড়তে থাকে। শিল্পায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ এই নদীকে একটু একটু করে ধ্বংস করে দিয়েছে। শিল্পকারখানার বর্জ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বর্জ্য—সবগুলোর শেষ ঠিকানা এই বুড়িগঙ্গা। প্রতিনিয়ত প্রায় ৩ কোটি মানুষের ব্যবহৃত বিষাক্ত পানি ও বর্জ্য এসে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। অপরিশোধিত বর্জ্যের প্রতিটি ফোঁটা এই নদীর শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে! ক্রমাগত দূষণে এর পানি এখন কালচে আকার ধারণ করেছে, উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। নদীর পানিতে ভাসছে নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনা। এর সঙ্গে বিশ শতকের নতুন আবিষ্কার পলিথিন দূষণের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বুড়িগঙ্গা পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম দূষিত নদীতে। নদীর এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী মানুষ। বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াই মুশকিল হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে, বেড়ে গেছে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ। শুধু দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নয়, পানির বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে যত ধরনের সূচক আছে, সব ধরনের সূচকেই বুড়িগঙ্গার পানি জলজ প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী। শুধু তাই নয়, বুড়িগঙ্গার পরিবেশ মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। মাছ তো দূরে থাক, সাধারণ অন্য কোনো জলজ প্রাণীর অস্তিত্বও চোখে পড়ে না এই নদীতে।
সব মিলিয়ে বুড়িগঙ্গার অবস্থা এখন নাজুক। নদী হয়ে গেছে সংকুচিত। এই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে তুলতে দরকার সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের জমা হওয়া বর্জ্য অপসারণ করতে হলে হাতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। উদ্যোগ নিতে হবে ঢাকার অন্য নদীগুলোর সঙ্গে বুড়িগঙ্গার সংযোগ সারা বছর নাব্য রাখার। নদীতীর দখলমুক্ত করে জনসাধারণের জন্য হাঁটাচলার রাস্তা তৈরির সঙ্গে লাগানো যায় দেশীয় প্রজাতির গাছ। সরকারের সদিচ্ছা ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে দীর্ঘ মেয়াদে বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দিনে দিনে ইট-পাথরের জঙ্গল হয়ে ওঠা ঢাকাকে সুন্দর ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে বুড়িগঙ্গার হারানো রূপ পুনরুদ্ধারের বিকল্প নেই। দেশকে বাঁচাতে হলে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য, পরিবেশ রক্ষার জন্য, অর্থনীতির উন্নতির জন্য বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।