গতকাল ৮ মার্চ সারা বিশ্বে মহাসমারোহে পালিত হলো নারীদিবস। কত সভা, সেমিনার ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হলো এই দিবসটিকে কেন্দ্র করে; কিন্তু যাদের জন্য এই অর্জন, এই আয়োজন—সেই কোটি কোটি অবহেলিত, বঞ্চিত ও দরিদ্র নারী সে খবর রাখেনি বা রাখলেও তা উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছে বলে মনে হয় না।
পৃথিবীর প্রায় ১০০ কোটি মানুষের বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে যার মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী। তাদের দিন যাচ্ছে দুই বেলার আহার জোটাবার প্রাণান্তকর চেষ্টায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় ৫ লাখ নারী আগামী বছর ৮ মার্চ উদযাপনের আগেই গর্ভজনিত কারণে বা প্রসবের সময় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেবে। ৮০ লাখ নারী আগামী ৩৬৫ দিনের মধ্যে কোনো না কোনো সময় পঙ্গু হয়ে পড়বে হয়তো-বা একই কারণে। পৃথিবীর নারীদের বঞ্চনা, লাঞ্ছনা আর অবহেলার কাহিনী এভাবেই ফিরে ফিরে আসবে।
বিশ্বের ৮৭৬ মিলিয়ন নিরক্ষর মানুষের দুই-তৃতীয়াংশ নারী। কোনো কোনো দেশে আবার তাদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও উচ্চ পর্যায়ের বিষয়গুলোতে শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। আরব দেশে অন্ধকার যুগে কন্যাসন্তান হলে দুঃখে পিতামাতার মুখ কালো হয়ে যেত। অসহ্য মনোবেদনায় নিজের লোকদের থেকে আড়ালে তারা ভাবত—এই সন্তানকে রাখবে না, মাটিতে পুঁতে ফেলবে! (সুরা আন নাহল, আয়াত, ৫৮-৫৯) মহানবীর (স.) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে ৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসিরা নারীসমাজের জন্য বহু বিবাদ শেষে প্রস্তাব করে কেবল এইটুকু অনুগ্রহ করে যে ‘নারী প্রাণী’ হিসেবে মানেই বটে; কিন্তু শুধু পুরুষের সেবার জন্যই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।’ সে সময় যুগের সর্বাধুনিক ধর্ম ইসলাম নারীকে দিয়েছে মানুষের মর্যাদা। হুন্না লিবাসুল লাকুম ওয়া আনতুম লিবাসুল লাহুন্না—অর্থাৎ তারা তোমাদের পরিচ্ছদ ও তোমরা তাদের পরিচ্ছদ (সুরা আল বাকারা, আয়াত-১৮৭)। এখানে স্ত্রীলোকের অধিকারের কথা পুরুষ লোকের পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘মা’ হিসেবে একজন নারী পেয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ ক্ষেত্রেও হজরত আয়েশার (রা.) বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের দৃষ্টান্ত রয়েছে। অথচ আমাদের উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ঊনবিংশ শতকেও নারীদের ন্যূনতম শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। বেগম রোকেয়া তার ‘অবরোধবাসিনী’ গ্রন্থের ৮ নম্বর কাহিনীতে অন্ধ পর্দার প্রয়াস কতটা আত্মঘাতী হতে পারে তার বর্ণনা দিয়েছেন।
এবার তাকাই আমাদের উন্নয়নশীল দেশটির নারীদের দিকে। দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রটির পরিচালনার ভার নারীর হাতে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে সংসদ ও সমাজের বিভিন্ন শীর্ষপদে যোগ্যতা অনুসারে নারীরা আছেন সমাসীন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য সংস্কৃতি, আইনশৃঙ্খলা, সর্বস্তরেই বিভিন্ন পদে কমবেশি নারীর অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। যুগান্তকারী ঘটনা ছিল মেয়েদের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা, যা ছিল এতদিন কেবল পুরুষ-অধ্যুষিত। যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণ অনুসারে চাহিদা মতো মেয়েরাও স্থান পাচ্ছে যোদ্ধাশ্রেণিতে, যা আগে সীমাবদ্ধ ছিল মেডিক্যাল ও নার্সিং কোরের মধ্যে।
আসলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে লিখে গেছেন,—‘তোমাদের কন্যাদেরকে সুশিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।’ এটি হচ্ছে নারীমুক্তির চাবিকাঠি। নারীমুক্তির প্রথম মহা ইশতেহার ‘Vindication of the rights of women’-এর রচয়িতা মেরি ক্র্যাফট ১৮৯২ সালে আন্দোলন করলেও তার ১৩৬ বছর পর ১৯২০ সালে আমেরিকার নারীরা ভোটাধিকার পায়। যুক্তরাজ্যে পায় ১৯২৮ সালে। ভারতের সব প্রদেশে পায় ১৯২৯ সালে। কেবল মাদ্রাজের নারীরা পায় ১৯২১ সালে। দেখা যাচ্ছে, এই উপমহাদেশের চালিকাযন্ত্র নারী শক্তিকে সম্মান দিয়েছে উন্নত অনেক পশ্চিমা দেশের আগেই।
আমাদের দেশে মেয়েরা আজ ক্রিকেট, ফুটবলে শিরোপা ছিনিয়ে আনছে বিশ্বাঙ্গন থেকে। গবেষণা করছে নাসায়, প্লেন, ট্রেন চালাচ্ছে, প্যারাসুট দিয়ে আকাশযান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এসব আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব ভাবতে পারিনি। তবে পাশাপাশি এও ভাবতে পারিনি যে, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ নিত্যদিনের স্বাভাবিক খবরে পরিণত হবে। উত্ত্যক্ত, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, ব্যর্থপ্রেম, মত প্রকাশের দুঃসাহসী প্রতিবাদের সহিংস প্রতিক্রিয়া—এ যেন দিনদিন বেড়েই চলেছে।
শিক্ষা হচ্ছে সভ্যতার মূলমন্ত্র। শিক্ষাঙ্গনে আজ যে অসভ্যতার ঘাঁটি হয়েছে, তা আমাদের ব্যথিত করে, ক্রোধান্বিত করে, হতাশ করে। আগে জানতাম নারীর প্রতি সহিংসতার হোতা হচ্ছে পুরুষ। এখন দেখছি শিক্ষালয়ের মতো পবিত্র স্থানটি কলুষিত হচ্ছে নারীদের দ্বারা, নারী নির্যাতনের মতো সহিংস রাজনৈতিক তৎপরতায়। ইডেন কলেজে ছাত্রীকে স্টাম্প দিয়ে পেটানো, যৌনকর্মে বাধ্য করা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী যৌননিপীড়ন, সম্প্রতি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার ছাত্রী ফুলপরী খাতুনের নির্যাতন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নাগরিক সমাজ এতদিন যে সর্বস্তরের মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে এ ধরনের অঘটন বন্ধ করার কথা বলতেন, এসব দেখেশুনে তারাও যেন স্তব্ধ! চরম হতাশার কথা হচ্ছে, এখন সমাজ যেন নির্লিপ্ত পরিস্থিতিকে ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে এত নৈরাজ্য অতীতে কখনো দেখা যায় নাই।
আজ আমাদের সংগ্রাম হোক সব নির্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ অনুমোদিত সিডোকে (CEDAW) মন্ত্র করে আজ আমরা চাইব এই দুঃসহ কালের অবসান। আমাদের সংগ্রাম হোক উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুরুষের সমকক্ষ স্থানগুলোতে সহাবস্থান—পুরুষের প্রতিপক্ষ হয়ে নয়। অজস্র প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় দেশটিকে স্থিত করে এগিয়ে নেওয়ার মন্ত্রটি এতেই নিহিত আছে।