বাংলাদেশের চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সংকটগুলো কী ধরনের? বিস্তৃত পরিসরে বলতে গেলে এই সহজ প্রশ্নের উত্তরটাও অনেক জটিল হতে পারে। অভিভাবক হিসেবে আমাদের প্রথম সংকটের সম্মুখীন হতে হয় সন্তানকে কোন ধরনের স্কুলে ভর্তি করব তা নিয়ে। একজন অভিভাবক, যিনি তার স্নেহের সন্তানকে কাকডাকা ভোরে জোর করে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে স্কুল কিংবা কোচিং সেন্টারের দিকে দৌড়াদৌড়ি করেন; তিনিই ভালো বলতে পারবেন পিএসসি কিংবা জেএসসি আমাদের কী দিয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ, তারা বুঝতে পেরেছেন এ ধরনের পাবলিক পরীক্ষা শিশুদের মানসিক বিকাশকে কতটা ক্ষতির সম্মুখীন করে। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা নিয়েও বিতর্ক কম হচ্ছে না। বিশেষ করে সবাই কমবেশি প্রশ্ন তুলছেন ‘কথিত সৃজনশীল’ পরীক্ষা পদ্ধতিতে সৃষ্টিশীলতা কতটুকু তা নিয়ে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়ার পরীক্ষা পদ্ধতির নাম সবাই দিয়েছেন ‘ভর্তিযুদ্ধ। এরপর প্রচলিত শিক্ষা কতটুকু কর্মমুখী এবং সেখানে কারিগরি শিক্ষার সম্পৃক্তি কতটুকু। জীবনে খেয়েপরে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে এই সনদনির্ভর শিক্ষা কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা নিয়েও নানা জন নানা কথা বলছেন।
মূলত, যে শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ কোনো একটি বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করে এবং শিক্ষা শেষে জীবিকা অর্জনের যোগ্যতা অর্জন করে, তাকেই কর্মমুখী শিক্ষা বলা যেতে পারে। তবে আমরা জানি, শিক্ষা মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনার যেমন বিকাশ ঘটাতে পারে, তেমনি জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে তাকে সামর্থ্য ও দক্ষতা অর্জনেও সাহায্য করে। নানাবিধ নতুন আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞান আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করেছে। এর মাধ্যমে নিত্যনতুন কর্মদিগন্তও খুলে গেছে। ফলে বংশপরম্পরায় অভিন্ন পেশা ধরে রেখে নিশ্চিত জীবনযাপনের সময়টা আর নেই। তাই চারপাশের নিত্যনতুন যে কর্মক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছে, তার সঙ্গে গুরুত্ব বাড়ছে বিভিন্ন বিশেষায়িত শিক্ষার। আর এর জন্য বিশ্বেও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও সাধারণ শিক্ষার তুলনায় কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণে।
নিউ লিবারেল তথা নয়া উদারতাবাদের সম্প্রসারণ কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব ও চাহিদা দিনদিন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা জানি, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন এক অর্থে পুরো বিশ্বকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। আমরা চাইলে যে কোনো মুহূর্তে বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তে থাকা যার সঙ্গে প্রয়োজন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। এর মাধ্যমে শুধু কুশল বিনিময় নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিক্ষাও প্রভাবিত হয়েছে। এর প্রভাব রয়েছে শ্রমবাজারের ওপরেও। পাশাপাশি মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাবকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে, যার ফলে পুরো বিশ্বের চাহিদা ও শ্রমবাজারে পার্থক্য থাকছে খুব সামান্যই। আমরা বিশ্বের নানা দেশে যে জনশক্তি রপ্তানি করে রেমিট্যান্স অর্জন করছি, সেখানেও এই শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই।
আমরা জানি, বর্তমান বিশ্বের শ্রমবাজারে ‘সার্টিফিকেট তথা সনদের থেকে কর্মক্ষমতা তথা স্কিলের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে’। বেশির ভাগ বহুজাতিক কোম্পানি থেকে শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল জায়ান্টরা তাদের কর্মীর বেতন নির্ধারণের ক্ষেত্রে কর্মক্ষমতাকে গুরুত্ব দেয়। একটা সময় যেই শ্রম নির্ধারণ করা হয়েছিল কর্মঘণ্টা হিসেবে, সম্প্রতি সেটাকে সক্ষমতার মানদণ্ডে যাচাই করার চেষ্টা চলছে। যেখানে অপেক্ষাকৃত স্কিলড কর্মী অনেক আনস্কিলড কর্মীর তুলনায় কম সময় কাজ করেও কয়েক গুণ বেশি বেতন পাচ্ছেন। আমরা শুরু থেকেই অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করে কম আয় করি। তার বিপরীতে অন্য অনেক দেশ বহুগুণে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেকটাই টেকসই অবস্থানে চলে গেছে। শুধু টেকসই কর্মমুখী শিক্ষার কারণে ভারত, ভিয়েতনাম ও চীনের কর্মীরা উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ শ্রমবাজার নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছেন।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা এককালে যে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বাস করে সুখে-শান্তিতে জীবন কাটিয়েছেন, এখন সেই সুযোগ নেই। তখন পেশাগত শিক্ষা নিয়েও তাদের ভাবতে হয়নি। ফলে কৃষিকাজ, মাছের চাষ, ফল-ফলাদির চাষ কিংবা মাছ ধরার মতো বংশানুক্রমিক পেশাগুলো অবলম্বন করেও অনেকে বেশ সহজে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি নতুন একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, যা থেকে উত্তরণের পথটা বেশ বন্ধুর। জনসংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়ায় তার প্রচণ্ড চাপ পড়ছে সীমিত সম্পদের ওপর। তাই কৃষিকাজ, পোলট্রি, গরু-ছাগল-মহিষ পালন কিংবা মাছ চাষের মতো বংশানুক্রমিক পেশাগুলোতেও বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান’—প্রচলিত প্রবাদে অনেক জনপ্রিয় এই কথাগুলো বাস্তবে কতটুকু টিকে আছে? যাকে বলা হচ্ছে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’, সে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মাছ রাখতে পারছে কি? একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, বিশ্বের সব থেকে কম আমিষ তথা মাছ-মাংস খাওয়া দেশের তালিকায় অনেক ওপরের দিকে আছে বাংলাদেশের নাম। গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার দেওয়া তথ্যমতে, পুরো বছরে এক জনের ১ দশমিক ২৩ কিলোগ্রাম মাংস ভক্ষণেই হিমশিম খেতে হয়। অথচ সুষম খাবারের তালিকায় এই পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ার কথা। তাই বর্ধিত খাদ্যের জোগান দিতে গেলে পোলট্রি শিল্পে আমাদের আরও মনোযোগ দিতে হবে। গরু-ছাগল-মহিষ পালনের ক্ষেত্রেও আধুনিক প্রযুক্তিকে সংযুক্ত করতে হবে। আর এ কাজে অবশ্যই আমাদের কর্মমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স অনেকাংশে নির্ভর করে যে পোশাকশিল্পের ওপর, সেখানেও টেকসই উন্নয়নের জন্য ভকেশনাল ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা বিশ্বের নানা দেশে যে জনশক্তি রপ্তানি করি, তাদের বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা, নার্সিং প্রশিক্ষণ ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দিতে পারি। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে দেখতে গেলে বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে একের পর এক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। কিন্তু অনেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন ও সমাজকর্মের মতো বিষয় খুলে রাখা হয়েছে। এই বিষয়গুলো তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন নানা কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানো হয়। আমি সন্দিহান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই বিষয়গুলোর উপযোগিতা কতটুকু রয়েছে। অনেকে যখন সমালোচনা করেন এই বিষয়গুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মাধ্যমে একমাত্র শিক্ষিত বেকার তৈরি বাদে তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না, আমি তাদের কথার প্রতিবাদ করার মতো উপযুক্ত উত্তর খুঁজে পাইনি।
আমরা জানি, কম্পিউটার রিপিয়ারিং মেকানিক, মোটর মেকানিক কিংবা অটোমোবাইল সার্ভিসিংয়ের মতো পেশাগুলোতে প্রচুর মানুষ কাজ করছেন। তবে তাদের কারো বিষয়ভিত্তিক কোনো ট্রেনিং নেই। পাশাপাশি গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট কিংবা ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটেও শিক্ষাদানের সুযোগ অনেক সীমিত। আমরা মনে করি, এখানেও কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়েছে। তাই সরকার ও জনগণের প্রচেষ্টায় আরও বেশি মানসম্পন্ন কর্মমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি। এছাড়া বস্ত্রশিল্প, সূচিকর্ম, জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙার কাজ, চিনিকল ও পাটকল, ইস্পাত শিল্প ইত্যাদি খাতে দক্ষ কারিগর সৃষ্টিতেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আর তার জন্য অবশ্যই সহায়ক কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
দেশব্যাপী কারিগরি শিক্ষার জন্য অনেক প্রফেশনাল ইনস্টিটিউট ও ভকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্বল্প খরচে মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, সিভিল, অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদির ওপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কোর্স করার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও বিভিন্ন জেলা শহরে এমনকি উপজেলা পর্যায়েও কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আবার কোথাও কোথাও এনজিও কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকেও কারিগরি জ্ঞান আহরণের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সেবা পরিষদ (জাশিপ)-এর মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এই শিক্ষার টেকসই উন্নয়নে নানা কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র প্রসারিত হলেও তাদের জন্য কর্মক্ষেত্র কেমন হতে পারে, পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে এর উপযোগিতা নির্ধারণ কীভাবে হবে—এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে জাশিপ। কয়েক জন অধ্যাপক, গবেষক এবং শিক্ষাবিদকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন জাশিপ প্রতিষ্ঠা করি, শুরুতে এই বিষয়গুলোকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলাম। আমরা বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে বারংবার একটা বিষয় উল্লেখ করেছি যে, ‘কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র এখন প্রসারিত হওয়া জরুরি এজন্যই যে, তাদের জন্য কর্মক্ষেত্র অবারিত।
অনেক প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত ব্যক্তির অভাবে তাদের প্রয়োজনীয় প্রজেক্টগুলো চালানো যাচ্ছে না। পাশাপাশি বিশ্বের নানা দেশ যখন দক্ষ জনশক্তির খোঁজ করছে, আমরা উপযুক্ত ব্যক্তি না থাকায় সেখানে সাড়া দিতে পারছি না। তাই কর্মমুখী শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে পারলে তাদের কর্মক্ষেত্র নিয়ে আমাদের আপাতত চিন্তা না করলেও চলবে। তাই শুরু থেকেই শিক্ষাকে গণমুখী ও কর্মমুখী করে তোলার চেষ্টা নিতে হবে। অবশ্যই কর্মক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে আমাদের এমন বিষয়ে শিক্ষা নিতে হবে, যা সনদধারী বেকার তৈরি না করে বিভিন্ন সেক্টরের জন্য দক্ষ কর্মী গড়ে তোলে।