শিক্ষা একটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা একটি। সংবিধানের ১৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকার প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও শিক্ষার গুণমান বাড়াতে বা শিক্ষাদান পদ্ধতির উন্নয়নে তেমন কোনো কার্যকর বা বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলে মনে হয় না।
শিক্ষার ভিত হচ্ছে প্রাইমারি শিক্ষা। একটা দালানের ভিত মজবুত না হলে যেমন দালানটি সোজা হয়ে বেশি দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীর প্রাথমিক শিক্ষাটা মজবুত বা জ্ঞানসমৃদ্ধ না হলে পরবর্তী জীবনে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। সংবিধানে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা থাকলেও বাস্তবে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের মতো শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিরাট বৈষম্য বিরাজ করছে। এছাড়া পল্লি এলাকার অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সময়মতো স্কুলে উপস্থিত থাকেন না। থাকলেও যেনতেনভাবে, অর্থাৎ যথাযথ গুরুত্বসহকারে তার দায়িত্ব পালন করেন না, যা একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়। এটাকে অনেকে সাবসিডিয়ারি কাজ হিসেবে বিবেচনা করেন বললেও ভুল বলা হবে না।
শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। এখানে শিক্ষা চলছে কোচিং-নির্ভর। শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানের চেয়ে কোচিং করাতে অধিক তৎপর। অভিভাবকেরাও ছুটে চলেছেন কোথায় ভালো কোচিং সেন্টার, কোথায় কোন শিক্ষকের কাছে পড়ে কে কত ভালো রেজাল্ট করেছে তার সন্ধানে। যে অভিভাবক সন্তানের পেছনে যত বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারবেন, তার সন্তান তত বশি ভালো একটা সার্টিফিকেট আনতে পারবে। সন্তান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ শিক্ষা পাচ্ছে কি না, তার মধ্যে ন্যায়নীতি, শিষ্টাচার, নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বোধ গড়ে উঠছে কি না, সেটা দেখার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন একটা ভালো রেজাল্ট। যে রেজাল্ট দিয়ে সন্তান নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ভালো বেতনের চাকরি পাবে। চটজলদি গাড়ি-বাড়ির মালিক হবে ইত্যাদি। এটাই দাঁড়িয়েছে শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের পরিণতি।
অনেকেই হয়তো জানেন, আফ্রিকার সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা’, যার সিংহদ্বারে লেখা রয়েছে, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণা করার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ এভাবে পরীক্ষা দিয়ে তৈরি হওয়া ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে, ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে দালানকোঠা-ইমারত ধ্বংস হবে, অর্থনীতিবিদদের দ্বারা দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে, বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে একটি জাতির অবলুপ্তি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার মতো ঘটনা কতটা ন্যক্কারজনক, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের সময় দেওয়ার পরিবর্তে নিজের আখের গোছানো নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। যাদের অর্থ-সম্পদ অঢেল, তারা তাদের সন্তানদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছেন। ভুরি ভুরি জিপিএ ফাইভ পেয়ে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসার পরও অনেক শিক্ষার্থী ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন না। এমনকি চাকরির বাজারেও তাদের ঠাঁই হচ্ছে না। এদের মধ্যে যারা মেধাসম্পন্ন, তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ উন্নত করার লক্ষ্যে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। এতে করে ব্রেন ড্রেন হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অমরা একসময় মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হয়ে যাব।
শিক্ষকদের নীতিনৈতিকতার অভাবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার পরিবেশসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ইডেন কলেজ, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাদের জন্য কী বার্তা বয়ে আনছে তা দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি। ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষার অব্যবস্থা নিয়ে বহু লেখালেখি হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। আমরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। আমাদের সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ আর এখনকার পরিবেশ আকাশ-পাতাল ফারাক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং শব্দটার সঙ্গে কখনোই পরিচিত ছিলাম না। একজন ছাত্র বা ছাত্রী কীভাবে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আর একজন ছাত্র বা ছাত্রীর ওপর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন করতে পারে, তা ভাবাও যায় না। এরা লেখাপড়া করে কী শিখছে? ভদ্রতা নম্রতা, শিষ্টাচার, নৈতিক মূলবোধের শিক্ষা কি এরা পেয়েছে? জীবনের শুরুতেই যদি এরা অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে, তাহলে পরিবার, সমাজ, দেশ বা জাতি এদের কাছে কী আশা করতে পারে? এ বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারিকুলামের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই হাতে-কলমে বাস্তবভিত্তিক/ব্যাবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে হবে। পড়ালেখার পাশাপাশি আদবকায়দা, শিষ্টাচার, ন্যায়নীতিবোধ, ধর্মীয় আচার-আচরণ, নাগরিক জ্ঞান, পরিবেশ জ্ঞানসহ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন মানুষ গড়ে তোলার মতো বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে। বাবা, মা, শিক্ষক, বয়োজ্যেষ্ঠদের বা প্রবীণদের প্রতি কী ধরনের আচরণ করবে, সেগুলোও পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত করে পাঠদান করতে হবে।
স্বাধীনতার এক যুগেরও বেশি সময় আমরা পার করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে তা তো প্রতিনিয়ত দেখতেই পাচ্ছি। যা হোক, বিশ্বায়নের যুগে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষার্থীদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই মানদণ্ডেই গড়ে তুলতে হবে।