কাগজ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। আমরা যে বই পড়ি, খাতায় লিখি, খবরের কাগজ পড়ি, সবই কাগজ থেকে তৈরি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে কাগজশিল্পে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্থিরতা। অসহনীয়ভাবে বেড়ে চলেছে কাগজের দাম। ফলে বই, পত্রিকা ও ম্যাগাজিনসহ কাগজ-জাত পণ্যের মূল্য বাড়ছে হু হু করে। লাগামহীনভাবে কাগজের দাম বাড়া বইপুস্তক ও সংবাদপত্রসহ তাবৎ প্রকাশনা শিল্পের জন্য অশনিসংকেত। বর্তমানে মানুষ ডিজিটাল ডিভাইসের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। ফলে আগের তুলনায় মুদ্রিত খবরের কাগজ কম পড়ে মানুষ। অনেকের মধ্যে এমন ধারণা আছে, ভার্চুয়াল মাধ্যমেই যেহেতু সংবাদ পাওয়া যায় সহজেই, তাই মুদ্রিত কাগজ পড়ার দরকার নেই। এক্ষেত্রে বলতে হয়, মুদ্রিত কাগজের আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে—যা সব সময়েই ছিল, আছে এবং থাকবে। এখনো অধিকাংশ মানুষ সকালে ঘুম থেকে ওঠে খবরের কাগজ পড়ার মধ্য দিয়ে দিন শুরু করেন।
বর্তমানে কাগজের দাম বাড়ার কারণে প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের দাম বেড়েছে। অনেক সংবাদপত্র মুদ্রণ সংখ্যা কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ, মুদ্রিত কাগজ সংকটের সম্মুখীন। অন্যদিকে কাগজের দাম বাড়ার কারণে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। এ সংবাদ আদৌ ভালো নয়! বর্তমানে এক টন কাগজ কিনতে গুনতে হচ্ছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। প্রতি রিম কাগজের দাম ৬০০ টাকার ওপরে। এই বাড়তি দামের প্রভাব পড়ছে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পে। এমন অনেক প্রকাশনী আছে, যারা কর্মচারীদের বেতন ঠিকমতো দিতে পারছে না।
১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী পেপার মিল দেশের প্রথম পেপার মিল। বাংলাদেশে ২০৬টি কাগজ তৈরির কারখানা রয়েছে বটে, তবে বর্তমানে ছোটবড় মিলিয়ে সচল আছে ৭০ থেকে ৭৫টি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কাগজের ধরন, মান ও ব্যবহার অনুযায়ী কাগজকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। লেখার কাগজ, ছাপা কাজে ব্যবহৃত কাগজ, নিউজপ্রিন্ট এবং প্যাকেজিং কাগজ। কাগজের বাজারে অস্থিরতার কারণে এই চার ধরনের কাগজের দামই এখন উর্ধ্বমুখী। নিউজপ্রিন্ট কাগজ উৎপাদনে দেশীয় পুরোনো কাগজ ব্যবহার করা যায়। তবে পুরোনো কাগজ দিয়ে সাদা কাগজ উৎপাদন করা যায় না। সাদা কাগজ তৈরিতে উন্নতমানের কাঁচামাল-উপাদান ব্যবহারের দরকার পড়ে। অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলনা নিউজপ্রিন্ট বন্ধ হওয়ার পর বেসরকারি কাগজ প্রতিষ্ঠানগুলো একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। নানা বাহানায় বারবার কাগজের দাম বাড়াচ্ছে তারা। এমনকি এ খাতে জেঁকে বসেছে অসাধু সিন্ডিকেট গোষ্ঠী।
কাগজ তৈরির মূল উপাদান ‘পাল্প’ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বাড়ার পর থেকে আমদানিকারকরা ঠিকমতো ব্যাংকে এলসি খুলতে পারছেন না। এই অজুহাতকে সামনে এনে বারবার কাগজের দাম বারবার বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুত্সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার চিত্র তো আছেই। সব মিলিয়ে হতাশাজনক চিত্রই দৃশ্যমান। এমতাবস্থায়, কাগজশিল্পের এ দুর্যোগকালে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের মূলোত্পাটনে ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, অস্বাভাবিক হারে কাগজের দাম বেড়ে গেলে কাগজশিল্পনির্ভর খাতগুলো মারাত্মক হুমকি ও অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়বে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এছাড়া বিশেষ করে কাগজ কারখানার গতিশীলতা বজায় রাখতে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখার বিকল্প নেই। কাগজ ও প্রকাশনা শিল্প বাঁচাতে এসব ব্যাপারে নজরদারিসহ সরকার যথাযথ ও ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেই মনে করি আমরা।