সম্প্রতি ভূমিকম্পের ঝুঁকি পেয়ে বসেছে আমাদের। এ ঝুঁকি কাটিয়ে ওঠার আগেই ভাবতে হচ্ছে ‘বিস্ফোরণ সমস্যা’ মোকাবিলা নিয়ে। গত এক সপ্তাহে দেশে সংঘটিত বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনা আমাদের বাকরুদ্ধ করেছে। এতে করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে! কেননা, এসব বিস্ফোরণ অসচেতনার বিষফল। সত্যি বলতে, সচেতনতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বরাবরই পেছনের সারিতে। দেশে একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনায় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হলেও টনক নড়ছে না কারো! এ অবস্থায় সচেতনতার পথে হাঁটা ছাড়া বিকল্প রাস্তা খোলা নেই আমাদের সামনে।
একটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া দরকার, উন্নয়নশীল দেশের উন্নতির জন্য শিল্প কারখানার ভূমিকা অপরিসীম। এসব কারখানা চালানোর জন্য গ্যাস সিলিন্ডার, জ্বালানি শক্তি, বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থ ও কেমিক্যালের ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এগুলো থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় কেবল বিস্ফোরণ ঠেকানোর চিন্তা থেকে এসব জিনিসের ব্যবহার বাদ দেওয়ার কথা চিন্তা করাটা অমূলক। বিস্ফোরণ হয়ে থাকে সাধারণত গ্যাসীয় পদার্থ থেকে। এক্ষেত্রে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলো মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তাই বিস্ফোরণ ঠেকাতে আমাদের প্রথমেই নজর দিতে হবে গ্যাসীয় পদার্থ ও কেমিক্যালের ওপর। এসব উপকরণ সচেতনতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারলেই বিস্ফোরণের ঘটনা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আমরা সাধারণত মনে করি, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের অধিক ব্যবহারের কারণে বিস্ফোরণ সমস্যা বেড়ে চলেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, রান্নার জন্য ব্যবহার করা সিলিন্ডার গ্যাস থেকে সরাসরি বিস্ফোরণ হয় না। বরং এসব সিলিন্ডারের যথাযথ পরিবহন, মজুত ও দীর্ঘদিন ব্যবহার না করার ফলে বিস্ফোরণের আশঙ্কা বেশি থাকে। সিলিন্ডারজাতকরণের সময় হোস পাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভে দুর্বলতার কারণে লিকেজ হয়ে গ্যাস জমা হতে থাকে। সেক্ষেত্রে আগুনের সামান্য স্পর্শেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। এক প্রতিবেদনে জানা গিয়েছে, ৫ থেকে ১০ শতাংশ বিস্ফোরণ ঘটে নিম্নমানের সিলিন্ডারের কারণে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তকারী ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মতে, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অসচেতনতার ফলেই এসব বিস্ফোরণগুলো ঘটে থাকে। একটি সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ বছর মেয়াদ থাকে। প্রক্রিয়াজাত করার ১০ কিংবা ১৫ বছর পর সে সিলিন্ডারগুলোর সেফটি ক্যাপ, রেগুলেটর, পাইপ, রাবার রিং ইত্যাদি যন্ত্রাংশগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। এ কারণে অবশ্যই সিলিন্ডার কেনার সময় সিলিন্ডারের গায়ে সিল দেখে নেওয়াটা অতি জরুরি। তাছাড়া অন্যান্য যন্ত্রাংশ ভালো আছে কি না তাও ভালো করে দেখে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাবধান-সচেতনতার মার নেই।
রাস্তায় আমরা প্রায়ই দেখি, বিশাল বিশাল ট্যাংকে লেখা থাকে—‘ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ হতে সাবধান’। এসব ট্যাংকে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। এসব যানবাহনে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, গ্যাস সিলিন্ডারগুলো ঠেলে কিংবা কাত করে যাচ্ছেতাইভাবে পরিবহন করা হয়। এতে করে গ্যাস লিকেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। বাসাবাড়িতে বিস্ফোরণ বন্ধে রান্নার সময় ছাড়া অন্যান্য সময় চুলা বন্ধ করে রাখতে হবে। রান্নাঘর রাখতে হবে খোলামেলা। রান্নার আগে ঘণ্টাখানেক জানালা খুলে রাখতে হবে। এ ধরনের সচেতনতার মাধ্যমে বাসা-বাড়ির বিস্ফোরণ কমিয়ে আনা সম্ভব।
আমাদের দেশে বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ হলো ‘কেমিক্যাল গোডাউন’। প্রায় প্রতিটি কারখানাতেই কেমিক্যাল গোডাউন থাকে, যাদের বেশির ভাগই অবৈধ। এসব অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন থেকে মারাত্মক সব বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকে শুধু নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে। এ বিষয়ে নজরদারিতে প্রশাসনকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। নতুন ভবন তৈরি সময় ভবনটিতে আগুন নেভানোর যথাযথ ব্যবস্থা, কেমিক্যাল মজুতের সক্ষমতা, মজুত লাইসেন্স প্রভৃতি বিষয়ে জোর দিতে হবে। মোদ্দা কথা, নিয়ম মেনে চললে বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষা পাব আমরা। একমাত্র সচেতনতাই পারে বিস্ফোরণের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে। বিস্ফোরণ রোধে ব্যক্তিসচেতনতার বিকল্প নেই।