আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ রকম অনিশ্চয়তার কারণেই বাংলাদেশের মতো প্রান্তস্থ দেশগুলোর দুটি কাজে গুরুত্ব দেওয়া উচিত—প্রথমত, যদি জ্বালানি তেলের বিকল্প থাকে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আমদানিনির্ভরতা কমানো। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন তুলনামূলক কম থাকে, তখন তেল বিক্রি করে যে মুনাফা অর্জিত হয়, তাকে দাম বাড়ার সময় জনকল্যাণে ব্যবহার করা
জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার সব সময়ই অস্থিতিশীল থাকে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ উৎপাদনের এসব উপকরণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-সংঘাত চলছে। জ্বালানি তেল নিয়ে বিশ্বব্যাপী ফটকা বাণিজ্য চলে ব্যাপকভাবে। আবার বিশ্ব রাজনীতিতে যে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত জ্বালানি তেলের দামের ওপর বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে। সেজন্য বিশ্বের কোথাও যুদ্ধ হলে বা যুদ্ধভাব সৃষ্টি হলেই জ্বালানি তেলের দামের ওপর এর প্রভাব পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইরানের সংঘাত বিশ্ববাজারে তেলের জোগান ও দাম দুটোকেই ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। অনেক দিন ধরেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এসব দেশ পরস্পরবিরোধি অবস্থানে রয়েছে। জ্বালানি তেল নিয়ন্ত্রণকারী বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশগুলো মাঝে মাঝেই এমন সব কৌশল গ্রহণ করে, যাতে জ্বালানি তেলের ওপর তার চাপ পড়ে। বিশ্বব্যাপী একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে—যখন কোনো সংকট সৃষ্টি হয়, তখন কিছু গোষ্ঠীর অপতত্পরতায় পণ্যের দাম বাড়ে, সম্পদের কেন্দ্রীভবন বাড়ে। করোনা এবং করোনা-পরবর্তী ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি এলএনজির দামও বেড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বৃহৎ ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগী সরকারগুলো সংঘবদ্ধভাবে কাজটি করে থাকে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ রকম অনিশ্চয়তার কারণেই বাংলাদেশের মতো প্রান্তস্থ দেশগুলোর দুটি কাজে গুরুত্ব দেওয়া উচিত—প্রথমত, যদি জ্বালানি তেলের বিকল্প থাকে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আমদানিনির্ভরতা কমানো। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন তুলনামূলক কম থাকে, তখন তেল বিক্রি করে যে মুনাফা অর্জিত হয়, তাকে দাম বাড়ার সময় জনকল্যাণে ব্যবহার করা। এটা করা উচিত এ জন্যই যে, এতে জনগণের ওপর জ্বালানি তেলের বাড়তি দামের প্রভাব কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশ এ দুটি কাজের কোনোটিই করেনি। অথচ বাংলাদেশের জন্য এটা বড় ধরনের আশীর্বাদ হচ্ছে, আমাদের গ্যাসের একটি বড় ধরনের মজুত রয়েছে। না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারত। গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ চলতে পারছে কারণ আমাদের গ্যাস আছে। বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা যেমন বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশ বাংলাদেশকে গ্যাস রপ্তানির জন্য চাপ দিয়ে থাকে। সেই সময় জনগণের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা না হলে গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্ত সম্ভবত নেওয়া হতো। গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে জ্বালানি তেলের জন্য আমাদের এখন যে ভোগান্তি হচ্ছে, তা আরো ভয়ংকর আকার ধারণ করত। বাংলাদেশে বহু শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধই থাকত। এসব দেশ ও সংস্থা জনপ্রতিরোধের কারণে বাংলাদেশকে গ্যাস রপ্তানিতে সম্মত করাতে পারেনি সত্য, কিন্তু তারা যে কাজটি করেছে তা হলো, জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের যে সক্ষমতা তা বাড়াতে দেয়নি। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হয়েছে অনেক বছর হলো, কিন্তু এখনো সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা হয়নি। আমরা যদি জাতীয় সক্ষমতার ভিত্তিতে সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে পারতাম, তাহলে জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কম থাকত। অনেক বেশি দামে এলএনজি আমদানিরও দরকার হতো না। অভ্যন্তরীণভাবে নতুন গ্যাসক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যবস্থা না করে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সক্ষমতা বিকশিত না করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
এগুলোর কারণে আমরা ভবিষ্যতে মারাত্মক বিপদে পড়তে যাচ্ছি। দেশে এলএনজি ও কয়লা আমদানিনির্ভরতা তৈরি হয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যে ভয়াবহতা, তা আমরা জানি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলে আমাদের উপকূলীয় এলাকা ছাড়খাড় হয়ে যাবে। সরকারি নীতির কারণে জ্বালানি তেল আমদানির পাশাপাশি এলএনজি ও কয়লা আমদানি করতে হচ্ছে। মূলত এসব কারণে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বালানি আমদানিনির্ভরতা কমানো যেত, যদি আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণভাবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া হতো। দেখা গেছে, আগামী কয়েক বছরে এলএনজি আমদানি বাবদ সরকারের ব্যয় হবে ১ লাখ কোটি টাকা, অথচ সেই একই পরিমাণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বাপেক্সের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা লাগে। অর্থাৎ এক শ ভাগের এক ভাগ অর্থ ব্যয় করলেই প্রয়োজনীয় পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ দেশের ভেতর থেকেই বাড়ানো যেতে পারে। এলএনজি আমদানিতে যে অর্থ ব্যয় হবে, তা করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। স্থানীয়ভাবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ অনেকটাই কমে যেত। এর জন্য প্রয়োজন ছিল শুধু জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো। আমরা অনেক দিন ধরেই জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলে আসছি, কিন্তু সরকারের আগ্রহ বেশি ব্যয়বহুল কাজে, বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ায়।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আবারও বাড়তে শুরু করেছে। কাজেই অভ্যন্তরীণ বাজারেও জ্বালানি তেলের দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা আছে। ২০১১ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত সময়ে সরকার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে জ্বালানি তেল আমদানি করেছে, তখন তার দাম দেশে জ্বালানি তেলের দামের চেয়ে তুলনামূলক কম ছিল। স্থানীয় বাজারে এই জ্বালানি তেল উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। ফলে সরকারের মুনাফা হয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা। গত বছর মার্চ-এপ্রিল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অভ্যন্তরীণ বাজারের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এই যুক্তি দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। অথচ গত ১২ বছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে যে মুনাফা অর্জিত হয়েছে, তার একাংশ ভর্তুকি দিয়ে হলেই অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেতো। কিন্তু সরকার সেই পথে না গিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিল। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ ব্যাপকভাবে বাড়ে। পণ্যের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সবশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সময় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পেলে স্থানীয় বাজারে দাম সমন্বয় করা হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ইউক্রেন যুদ্ধ পূর্বাবস্থায় চলে এলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি। মন্ত্রী তার বক্তব্যে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কথা না বলে সমন্বয়ের কথা বলেছেন। তাদের কাছে সমন্বয় মানে দাম বাড়ানো।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা নিজের হাতে রাখার জন্য সরকার ইচ্ছা করেই বিইআরসিকে অচল করে দিয়েছে। আগে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি অথরিটির মাধ্যমে গণশুনানি করতে হতো। এখন সরকার চাইলে যে কোনো সময় কোনো ধরনের গণশুনানি ছাড়াই বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারবে। গ্যাসের দাম তো আগেই বাড়ানো হয়েছে। ভবিষ্যতে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম আরো বাড়বে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে দেশের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়ছে। দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও কমছে।
এরকম পরিস্থিতিতে সরকার যদি জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করত, তাহলে আমদানিমুখী প্রবণতা থাকত না। জ্বালানি বিষয়ে আমদানিমুখী তৎপরতা কমিয়ে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করত। কিন্তু তা এখনো করা হচ্ছে না। সরকার যে এলএনজি আমদানি করছে, এর সঙ্গে বড় বড় ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী যুক্ত। জনস্বার্থ বাদ দিয়ে তাদের স্বার্থ দেখাই সরকার দায়িত্ব মনে করছে। এলপিজির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। দেশে যদি গ্যাসের সরবরাহ বাড়ে, তাহলে এলএনজি ও এলপিজি ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ মুনাফার একচ্ছত্র সুযোগ সংকুচিত হবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টির জন্য অভ্যন্তরীণ কারণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কারণও কাজ করছে। কাজেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমদানির পরিমাণ যতটা সম্ভব কমাতে হবে। যেমন—আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। আমরা সব সময়ই বলে আসছি, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প আমাদের জন্য মহাক্ষতিকর এবং আর্থিক বোঝা হবে। তাই এসব অপতত্পরতা বন্ধ করা হোক। সরকার কথা শোনেনি, এখন তারা বলবে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে, কাজেই এই মুহূর্তে তা বন্ধ করা হলে ক্ষতি হবে। কিন্তু আমরা বলছি, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করা হলে যে আর্থিক ক্ষতি হবে এগুলো চালু হলে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে। তাছাড়া এসব প্রকল্প চালু হলে আমদানিনির্ভরতা থাকবে। পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়বে, তার ক্ষতি হবে ভয়াবহ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষতি শুধু আর্থিক ক্ষতি দিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, আমদানিনির্ভর প্রকল্পের ব্যয়সহ বিভিন্ন তথ্য স্বচ্ছতার সঙ্গে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। যেগুলো পরিবেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ উন্নয়নের নামে কোনোভাবেই আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করা যাবে না। অনেক ধরনের অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর জিনিস আমদানি করা হচ্ছে, এই আমদানিনির্ভরতা যেকোনো মূল্যেই হোক কমাতে হবে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে পারলে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির হাত থেকে আমরা রক্ষা পাব।