গত ১১ মার্চ ২০২৩ দিবাগত রাতে বিনোদপুর বাজারে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুই দিনের সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করেছে। সবারই হয়তো এ ঘটনার উৎস, স্থান ও কাল জানা। ইতিমধ্যে মতিহার থানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় একজন গ্রেফতার হয়েছে বলে খবর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। তবু পেপার-পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যতটুকু জানা যায়, বাসে ছাত্র ও সুপারভাইজার কর্তৃক সামান্য ঘটনাই ছিল এর কেন্দ্রবিন্দু।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশের বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এটি একটি। দেশে নতুন গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে চলবে তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে শেখার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে ওঠেনি। না শিখেছে স্থানীয় লোকজন আর না শেখাতে পেরেছে বিশ্ববিদ্যালয়। বারবার এরকম ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো পরিবর্তনের উদ্যোগ আমাদের নেই। এবার যে ঘটনাটি ঘটল, তা অত্যন্ত ছোট একটি ঘটনা, যা হরহামেশা বাসযাত্রী ও সুপারভাইজারের সঙ্গে ঘটে থাকে। তাই বলে কি তারা সবাই আইন হাতে তুলে নেবে? আমাদের পরিবহনগুলো এমনি যাত্রীতে ঠাসা, তার ওপর বৈশ্বিক মন্দার কারণে বাড়তি ভাড়া এবং ছাত্রদের জন্য কোনো বিশেষ প্যাকেজও নেই বলা চলে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যদি বাস ও ছাত্রদের মধ্য সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে হয়তো অন্য রকম হতো। সব থেকে পরিতাপের বিষয় এই ছোট ঘটনায় স্থানীয় লোকজন সুপারভাইজারের পক্ষ নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া। এটা নেহাতই কোনো স্থির ও সুস্থ ব্যবসায়িকের কাজ হতে পারে না। স্থানীয়ভাবে ছাত্ররা এসব মানুষের ব্যবসার মূল প্রাণশক্তি। প্রতি মাসে গড়ে প্রতিটা ছাত্র যদি ৩ হাজার টাকা এখানে নিয়ে আসে, তাহলে প্রায় প্রতি মাসে রাবির ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা রাজশাহীতে কমপক্ষে সাড়ে ৯ কোটি টাকা ইনভেস্ট হয়, আর অন্য প্রতিষ্ঠানের কথা বাদই দিলাম। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া স্থানীয় লোকজনের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের অসম্মান করা বা শারীরিক ক্ষতি করা বা অন্য কোনো পক্ষের হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া কাম্য নয়। বিষয়টি যখন এরকমই, তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে পারত। তবে হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু জরুরি হেল্পলাইন থাকা উচিত, যা বর্তমান অবস্থায় নেই। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পেশাল কমিউনিটি পুলিশ দেখেছি। কিচেন পুলিশ দেখেছি, পারকিং পুলিশ দেখেছি। ছাত্রছাত্রীদেরও নিয়মনীতি বলেন, আইন বলেন, বিধিবিধান বলেন মেনে চলা উচিত। ছাত্রছাত্রী অপরাধ করলে প্র্রকৃত অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত। তবে সব কথার শেষ কথা, তারা ছাত্র। ছাত্ররা উন্নত বিশ্বেও একটু অন্যরকম, মানে ফ্রেশ, প্রতিবাদী, নতুন চিন্তার ধারক, বিপ্লবী, সৃষ্টিশীল, আবেগপ্রবণ। তাই তাদের জন্য একটু অন্যরকম সুবিধাও থাকা উচিত। এছাড়া দেশব্যাপী সব পরিবহনে ছাত্রছাত্রীদের ২০-৪০ শতাংশ ভাড়া কমানোর একধরনের পলিসি এবং সেটা মাসে কত বার একজন ছাত্র ভোগ করবে, সেটা থাকা উচিত। ডিজিটাল পাঞ্চ কার্ড থাকবে তাদের হাতে। আর বাসগুলোও তো ঢেলে সাজাতে হবে সেভাবে। শুধু বাসগুলো আয় করে যাবে অথচ আধুনিকায়ন হবে না, তা তো হয় না। নিরাপদ সড়কের জন্য এ সবই দরকার। ভবিষ্যৎ স্মার্ট বাংলাদেশের জন্যও পরিবহনের আধুনিকায়ন দরকার। সেগুলো ভবিষ্যতে সরকার ভাবতে পারে।
যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ঘটনা যে আজকে ঘটছে তা কিন্তু নয়। অতীতেও অনেক ঘটনা ঘটেছে। সেখান থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কেবল তীব্র নিন্দাই জানাতে পারি। সেই সঙ্গে স্থানীয়দের ও শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল আচরণ করার জন্য অনুরোধ জানাই। এসব ঘটনায় যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে যায় উভয় পক্ষের। সংঘর্ষ কখনো ভালো ফল বয়ে আনে না। অনেক ছাত্র ও স্থানীয় ব্যক্তিরা আহত হয়েছে, তাদের প্রতি সমবেদনা জানাই একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে। তবে এ ঘটনা যাতে আরো ভয়াবহ রূপ না নিতে পারে, সে জন্য যথার্থভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে, ভূমিকা রাখতে হবে। কেননা, যে ক্ষতিটা হবে, তা পুষিয়ে নেওয়া অনেক কঠিন। শিক্ষার্থীদের বলতে হয়, জেদ, অহংকার, রাগ, আবেগ—এসবকে পাশ কাটিয়ে বাস্তবতার নিরিখে তোমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ তোমাদেরই ঠিক রাখতে হবে। করোনার দীর্ঘ থাবা রাবি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। আর এই সময়ে যদি এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা রাবিকে পিছিয়ে দেয়, তাহলে ক্ষতি শুধু তোমাদেরই হবে! তাই সবার স্বার্থে সবাই সহনশীল আচরণ করে ছাত্রছাত্রীদের যৌক্তিক দাবি যতটুকু মানা যায় মেনে নেওয়া হোক, অস্থিতিশীল পরিবেশ কারো জন্যই সুখের নয়। স্থানীয় লোকজন দুঃখ প্রকাশ করুক এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের প্রকৃত করণীয় খুঁজে বের করা উচিত।