ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি বিশেষ একটা ঝোঁক ছিল ত্রমিলা বড়ুয়া তৃণার; তবে সেটা ছিল নিতান্তই শখের। মাঝখানে অনেকটা বছর তিনি আঁকাআঁকি থেকে দূরে ছিলেন বটে; তবে ২০২০ সালের করোনা মহামারিতে যখন সবাই প্রায় গৃহবন্দি অবস্থায়, তখনই তার মধ্যে নতুনরূপে আবির্ভূত হয় ‘হ্যান্ডপেইন্টিং’-এর মতো লুপ্তপ্রায় এক অঙ্কনশৈলীর। এতে তার উত্সাহ এবং উচ্ছ্বাস আরো বেড়ে যায়। তবে এ শিল্পকর্মের পরিধি ছিল সীমিত আকারে। দিন যত গড়িয়েছে আস্তে আস্তে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেলেও জনগণের মধ্যে খুব একটা প্রচারবহুল হয়ে উঠতে পারেনি। সেই দুর্লভ এবং কঠিন শিল্পকর্মটিকে আবারও প্রচলন ঘটানোর চেষ্টা করছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ৩য় বর্ষের অনার্স শিক্ষার্থী ত্রমিলা বড়ুয়া।
হ্যান্ডপেইন্টিং বা হাতে আঁকা/নকশা করার কাজ শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩ হাজার বছর আগে (গুগল থেকে প্রাপ্ত) এশিয়া মহাদেশের কিছু অংশবিশেষে। পুরোনো এই অঙ্কনশৈলী বিশেষভাবে করা হতো কাপড়ের ওপর, যা আজও ফেব্রিক পেইন্টিং নামে পরিচিত। তবে হ্যান্ডপেইন্টিং কেন আলাদাভাবে পরিচিতি, এর বিশেষত্ব এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে কারণ কী, এ নিয়ে নানা মতামত আছে। যান্ত্রিক ডিজাইন নকশার ভিড়ে হাতে করা কোনো নকশা বা ছবি এখনো মূলবান এবং মানুষ তা সংগ্রহ করতে চায়। এর কোনো ডুপ্লিকেট বা দ্বিতীয় ভার্শন সম্ভব না হওয়ায় সংগ্রহকারী বেশ স্বস্তিকর শিল্পের একক সংগ্রহেই থাকেন।
ত্রমিলা বড়ুয়া তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, হ্যান্ডপেইন্টিংকে কোনো নির্দিষ্ট পৃষ্ঠতলে সীমাবদ্ধ না রেখে শিল্পীরা চেষ্টা করেন তা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে। অর্থাৎ প্রথমে কাপড় থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে তা কাঠ, মাটি, পাট ইত্যাদি; এবং এমন যেসব বস্তু রং শোষণ করতে ও টিকিয়ে রাখার কাজ করতে সক্ষম তাতেই হ্যান্ডপেইন্টিং করার প্রচলন হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, ২০২০ সালে যখন হ্যান্ডপেইন্টিং ধারাটি পুনরায় জনপ্রিয় হতে থাকে, সে সময় শিল্পীরা কাঠ, মাটি থেকে তা প্লাস্টিক, কাচ, বাঁশ, লোহা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি নানা ধরনের পৃষ্ঠে কাজ করা শুরু করে। যার ফলস্বরূপ নতুন ধরনের, ভিন্ন ভিন্ন রকমের জিনিসপত্র গ্রাহকদের নজর কাড়ছে। যেমন হাতে নকশা সানগ্লাস, আয়না, ঘর সাজানোর সামগ্রী ইত্যাদি। ত্রমিলা বড়ুয়া এই শিল্পের প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে মনে করেন—হ্যান্ডপেইন্টিংয়ের বিশেষত্ব হলো, রং শোষণকারী যে কোনো ফ্যাকাশে, মলিন কিংবা পুরোনো বস্তুকে নিমেষেই এক শৈল্পিক এবং নজরকাড়া রূপ দিতে এটি সক্ষম। বলা যায়, এ শিল্পধারা জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবকিছুতেই পটু। এছাড়াও এ কাজের দ্বারা নতুন নতুন, দৃষ্টিনন্দন, শৈল্পিক কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব। বর্তমানে বেশ কজন শিল্পী মগ্ন হ্যান্ডপেইন্টিংয়ের মাধ্যমে আরো নতুন কিছু সৃষ্টিতে। যা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও নিজেদের ঐতিহ্য, শৈল্পিক জ্ঞান এবং সৃজনশীলতার এক অনন্য পরিচয় বহন করতে সক্ষম। ত্রমিলা নতুন মাত্রার একটি প্রকল্প ২০২১ সালে চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। ফানুসের গায়ে রং করা, অর্থাৎ হ্যান্ড পেইন্টেড ফানুস। ২০২১ সালের প্রবারণা পূর্ণিমায়, অ্যাক্রিলিক মতো ঘন রং ফানুসের পাতলা কাগজে বসিয়ে হাতে আঁকা ফানুস তৈরি করার দুঃসাহস করে সে বছর সফল হয়েছিলেন ত্রমিলা। এরই সঙ্গে সেই হ্যান্ডপেইন্টেড ফানুস বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সবার মাঝে। এবং ২০২২ সালের প্রবারণা পূর্ণিমায় বেশ কিছু বৌদ্ধ সংগঠন এ ধরনের ফানুসের কাজ করে, যা নান্দনিক ও শৈল্পিক ভাবের আরেকটি নিদর্শন।
হ্যান্ডপেইন্টিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকের হৃদয় জয় করা প্রসঙ্গে ত্রমিলা বড়ুয়া তৃণার বক্তব্য হলো, এ শিল্পকর্মের জনপ্রিয়তার পেছনে একটি কারণ হলো, এটির মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে তাদের মনমতো এবং রুচিসম্মতভাবে (কাস্টমাইজড) যে কোনো কাজ উপস্থাপন করা যায়। গ্রাহক জামাকাপড় থেকে শুরু করে ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিংবা পরিধানের গয়নাগাটি যে কোনো কিছু তাদের নিজেদের ইচ্ছা ও পছন্দমতো অঙ্কন করাতে পারেন এ শিল্পের মাধ্যমে। হ্যান্ডপেইন্টিংয়ের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে রিকশাপেইন্টিংও বেশ চর্চা হচ্ছে।
ত্রমিলা বড়ুয়া মনে করেন, হাতে আঁকা চিত্রকর্মের গুরুত্ব এবং সৌন্দর্য অতুলনীয়। এ শিল্পধারার মধ্যে আছে তাদের পুরোনো পরিচয়। আর শিল্প কখনো পুরোনো হয় না। নতুন জন্মে, নতুন রূপে ফিরে আসা পুরোনো এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে বাড়াতে হবে কাজের পরিধি এবং বিস্তার ঘটাতে হবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এতে করে শুধু এই শিল্পকর্মটা বেঁচে থাকবে না, বরং শিল্পীরাও তাদের কাজকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন এবং যোগ্য সম্মান পাবেন।